সেই ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার আগেই এক চিলতে ঘরটায় একটা ছোট মতন তালা ঝুলিয়েই বাড়ি ছেড়েছিল ছোটকু। কি আর নেবে চোরে, আছেটাই বা কী! যতটুকু বা ছিলো তা মায়ের সংগেই চলে গেছে। শূন্য ঘরে থাকার মধ্যে রইল ছাল ওঠা কলাই করা থালা-বাটি-গ্লাস। মাযের অনুপস্থিতে খেঁদী পিসি ওতেই দুটো খেতে দিত, তাও ওগুলো এঁটো আবস্থায়ই রয়ে গেল। মা যদি এর মধ্যে এমুখো হয়, তবে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে যা করার করবে। সেই মাস ছয়েক আগে কয়েক ঘন্টার জন্য এসেছিল, ওরে সে কি ব্যস্ততা তার। অইটুকু সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকবার তার প্রকাশ ঘটলো, ‘তুই জানিস না ছোটকু, সেই মাগী বেচারীর কী কষ্ট! চোখে দেখা যায় না। মাকে দেখলে কিন্তু ছোটকুর একটুও মনে হয় না যে মাকে খুব ঝামেলার কাজ করতে হয়!ইদানিং বেশবাস-এ বেশ চোখে লাগার পরিবর্তন হয়েছে, বেশ সুখী সুখী ছাপ পড়েছে চেহারায়! তাই ও মনস্থির করে ফেলেছিল যে ও নিজেও সল্টলেকের করুণাময়ী বলে জায়গাটায় ঘুরে ঘুরে যে কোনও একটা কাজ খুঁজে নেবেই নেবে।
এই সব ভাবতে ভাবতেই ছোটকু ডোমজুড় মোড়ে এসে হাজির। শেষবার সেই ছমাস আগে ওর মা যখন বাড়ি এসেছিল তখনই ও করুণাময়ী বলে জায়গাটায় যাবার সুলুক সন্ধান মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল। তাই ৬৩ নম্বর প্রাইভেট বাসটা স্টপেজে আসতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। এই বাস সলপ অবধি যাবে, তারপর ওখান থেকে ধুলাগড়-করুণাময়ী বাস ধরে ও করুণাময়ী যাবে।
ছোটকু এখন করুণাময়ী হাউজিং এস্টেটের প্রায় কুড়িটা বাড়িতে কর্মপ্রার্থী হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমানিত করতে ব্যর্থ হয়ে এগিয়ে চলেছে পূবদিক বরাবর। আশা, এখানে দ্বিতল, ত্রিতল এবং বেশ কিছু বহুতল বাড়িও ওর নজরে পড়েছে। প্রায় চার পাঁচ জায়গায় ব্যর্থ হয়ে একটা ছিমছাম দোতলা বাড়ির গেট সংকোচে ও সন্তর্পণে খুলে সদর দরজার ঘণ্টিতে মৃদু চাপ দেয়। দরজা খুলল না। একটু অপেক্ষা করে ছোটকু আবার ঘণ্টিতে হাত ছোঁয়াবার প্রায় সংগে সংগে দরজা খুলে গেল। ওপারে শক্তপোক্ত এক ভদ্রলোক, গলার স্বরও চেহারারই মতন, ‘কি চাই?’ ছোটকু ভয় পেয়ে বলে ওঠে, ‘কাজ।’ ‘এটা কি একটা ফ্যাক্টরী নাকি? যাও, যাও।’ বলে দরজা বন্ধ করতে যেতেই ছোটকু হুমড়ি খেয়ে লোকটির পায়ে পড়ে। দরজা খোলা রেখেই তিনি পিছিয়ে যান। ছোটকু ওর পা ছাড়ে না, মুখে একটাই কথা ‘আমাকে একটা কাজ দিন। যা করতে বলব তাই করব, যা দেবেন তাতেই করব।’ লোকটি এক ঝটকায় পা-দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে হুংকার দিয়ে বলে, ‘এ তো মহা আপদের পাল্লায় পড়া গেল, সব কাজ করবি বললি না? গু-মুত পরিষ্কার করতে পারবি?’ ছোটকু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে থাকে, ‘পারব পারব নিশ্চয় পারব,আমি করব।’ গৃহস্বামী তখন স্রাগ করে ওকে ভিতরে আসতে দিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে খাবার জায়গা পেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে একটা ঘরে ঢুকে ছোটকুকে ভিতরে ডাকলো, কই রে এদিকে আয়।’ পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে ভক্ করে গন্ধটা ওর নাকে লাগলো। তারপর সামনে দৃষ্টি মেলে যা দেখল তাতে ও বোবা বনে গেল, পা যেন আর সরে না। একটা কঙ্কালসার বউ গু-মুতের মধ্যে পড়ে আছে আর মৃদু স্বরে ককিয়েই যাচ্ছে শূন্য দৃষ্টি মেলে। আবার গৃহস্বামীর বাজখাঁই আওয়াজ, ‘কি রে দম ফুরিয়ে গেল? তখন তো খুব বড় বড় কথা বলছিলি,’ কাজ কাজই, কাজের আবার রকমফের কি?....’ ছোটকু সংগে সংগে বলে ওঠে,‘ সে তো ঠিকই, আমি এক্ষুনি সব পরিষ্কার করে দিছি দেখুন।’ ছোটকু ঘরের বাইরে যাবার উদ্যোগ নিতেই তিনি ওকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলেই হাঁক পাড়লেন, ‘রমা রমা দেখে যাও তোমার হেল্পিংগ হ্যাণ্ড এসে গ্যাছে, তোমার কষ্টের দিন শেষ...তাড়াতাড়ি এসো...দেখে যাও।’ 'আসছি গো আসছি' বলে ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়া মাত্র শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এ ঘরে রমার প্রবেশ এবং যুগপত্ রমার এবং ছোটকুর আর্তনাদ 'তুই?'...মাআআ..!!.'
ছোটকু করুণাময়ীর রাস্তা দিয়ে ছুটছে....ছুটছে.....ওর দু-চোখে আষাঢ়-শ্রাবণ ধারা...