শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০১৭

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

'বসন্ত তার গান লিখে যায়
ধূলির পরে’ -----
রবীন্দ্রনাথের নিজের এই কথা থেকেই স্পষ্ট , প্রেমিক বসন্ত তার প্রেমের গান লিখে চলে মধুর এ পৃথিবীর বুকে ... অবারিত গুঞ্জনে ।
আকাশে বাতাসে এখন ফাগুনিয়া আলাপ ... জ্যোৎস্নাধারায় এখন ঝর্ণার মিলন কলতান ... দৈনন্দিন জীবনের অমানিশা ভেদ করে আকাশে বাতাসে এখন ’ঋতুরাজ বসন্তের রঙ-বিলাস ।
' আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুম-কোমল--
কার অনাদরে আজি ঝরে যায়।
কেন কাছে আস, কেন মিছে হাস,
কাছে যে আসিত সে তো আসিতে না চায় '
১২৯৫ এর অঘ্রাণে রচিত , এ গানটি স্থান পায় মায়ার খেলা ' তেও ... রবীন্দ্রনাথ তখন দার্জিলিঙে ... পাহাড়ে সমতলে সদ্য উন্মোচিত আম্র-মুকুলের বসন্ত ঘ্রাণ কবির মনন থেকে এ গানে সঞ্চারিত ।
বসন্ত ' যেমন প্রেমের ঋতু , তেমনই বসন্ত বিরহেরও ঋতু ...
'সুখে আছে যারা, সুখে থাক্‌ তারা,
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা,
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখী জনে যেন দেখিতে না পায় '
আর এই বসন্তেই কাজি নজরুলের কলমে উদ্ভাসিত নারী'র জগৎ-মোহিনী রূপটিরও ...
'আমি নারী, আমি মহীয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী।
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা-ওঠা,
মিথ্যা হত কাননে ফুল-ফোটা'
এরই মাঝে ২৬ শে মার্চ রোদ্দুর ' পা রাখলো দ্বিতীয় বর্ষে ... দীর্ঘ চব্বিশটি মাস রোদ্দুরের পাশে যারা ছিলেন , আছেন এবং থাকবেন ... সকল কে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ।
কলমের মধ্যস্থতায় উন্মীলিত হোক ... সাহিত্যের নবতম অলিন্দটি ।
শুভেচ্ছান্তে ,
পিয়ালী বসু


বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭

অভাগিনীর পত্র --- রীনা রায়

শ্রীচরণেষু বাবা,
 
এই প্রথম তোমাকে চিঠি লিখছি, জানিনা মেয়ের লেখা বলে এ চিঠি তুমি আদৌ পড়বে কিনা। জানি, অবাক হচ্ছো, ভাবছো কেনই বা আমি তোমাকে চিঠি লিখলাম। আসলে, 
চলে যাবার আগে তোমাকে মনের কষ্টটা বলে যেতে বড় সাধ হল ।
বাবা, জানি আমার জন্ম তোমার বা ঠাকুমার কাছে এতটুকু আনন্দের ছিলনা।
আমার জন্মের সময় কেউ একটাও শাঁখ বাজায়নি, শুনেছি তুমি বা ঠাকুমা বহুদিন আমার মুখও দেখতে চাওনি। তোমরা ছেলে চেয়েছিলে, তোমাদের বংশধর চেয়েছিলে, তাই ভাই যখন জন্মাল তোমাদের আনন্দ দেখে মনে হত মায়ের কোলে যেন কোনো মহাপুরুষ 'অবতীর্ণ' হয়েছে! 
ভাই নাকি তোমাদের সমস্ত 'অপকর্ষ ' থেকে উদ্ধার করবে! 
বাবা, ঠাকুমা না হয় সেকেলে মানুষ কিন্তু তুমি তো এইযুগ সম্পর্কে 'অজ্ঞ' নও, তুমি তো জানো, এ'যুগে মেয়েরা পারেনা এমন কোন কাজ নেই, তবুও কন্যাসন্তানের প্রতি এত অবহেলা কেন? 
আমি দেখতাম, ভাই কিছু চাওয়ার আগেই সেই জিনিসটা পেয়ে যেত, আর আমার দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যক জিনিসগুলোও তোমার কাছে 'অনাবশ্যিক' বলে মনে হত--
ভাইয়ের শত অপরাধেও তোমরা ওকে শাসন করা থেকে 'বিরত' থেকেছো।
আমি অবাক হয়ে দেখতাম, কোন কিছুর প্রতি আমার 'অনুরাগ' জন্মালেই তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে সেটা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে ----
আমি আর পারছিনা বাবা, দিনের পর দিন তোমাদের কাছ থেকে এত অবহেলা পেতে পেতে মনের অবচেতনে নিজের প্রতিই একটা ঘৃণা জন্মেছে, তাই 'ঐহিক' সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি অত্যন্ত 'সচেতন'ভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম, সেই সঙ্গে তোমাদেরও মুক্তি দিয়ে গেলাম।
বাবা, আমি কিন্তু তোমাদের সবাইকে খুব ভালবাসি, তোমরা যদি আমাকে একটু কাছে টেনে নিতে---
আমার প্রণাম নিও ।


ইতি তোমার হতভাগী কন্যা 
হিমানী।

পাইকপাড়া, কোলকাতা

নীলকণ্ঠীয় পরিতৃপ্তি ---- মুনমুন মুখার্জী

বি পজিটিভ উদিতা। জীবন মানেই পরিবর্তন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়াই হল, লাইফ লার্নিংস। এই লার্নিংসগুলোই তো সমৃদ্ধ করে আমাদের।
গত দু’ঘন্টায় এটি তৃ্তীয়বার চ্যানেলের কর্ণধার পলাশ বর্মণ বিদেশী ওয়াইনের গ্লাস হাতে উদিতাকে জীবন-দর্শনের লেকচার দিচ্ছেন। গত সন্ধ্যার “মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলাপচারিতা” শো’টির অভুতপূর্ব সাফল্যকে সেলিব্রেট করতেই আজকের এই পার্টি। এই লেকচারের নিগূঢ় কারণঃ শো’টির ভাবনা, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, পরিচালনা আর পরিবেশনার সব দায়িত্ব উদিতার হওয়া সত্ত্বেও সাফল্যের ক্রেডিট ওকে ভাগ করে নিতে হচ্ছে সদ্য নিযুক্ত নিউজ প্রেজেন্টার বিপুল সরকারের সাথে। কেন? বিপুল কোন এক আমলার অকালকুষ্মান্ড সন্তান, যিনি সম্প্রতি চ্যানেলকে বিরাট অঙ্ক ডোনেট করেছেন। আর তাই কাল প্রোগ্র্যাম “অন এয়ার” হওয়ার ঠিক আধঘন্টা আগে উদিতাকে জানানো হয় বিপুলও থাকছে উদিতার সাথে। উদ্দেশ্য – সরকারের ওপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। উদিতার তৈরী স্ক্রীপ্ট রীডিং পড়ে শো-এর সাকসেসের ক্রেডিট ওর উপরি পাওনা।
গত চার বছরে পরিবর্তনের আঁচ কী পায়নি উদিতা? রাজনৈতিক হাওয়া বদলের সাথে সাথে চ্যানেলের পাল পরিবর্তন, সংবাদ পরিবেশনের ধারা বদল সবই তো পরিবর্তনেরই অংশ যাতে চ্যানেলের ট্যাগলাইন, “আমাদের নির্ভীকতা আপনার নির্ভরতা” যথার্থতা হারিয়েছে।
মোবাইলের রিংটোন চিন্তাসূত্র বিচ্ছিন্ন করল। হাতের পানীয় নিঃশেষে গলায় ঢেলে কল নিতেই গলা আর মন দুটোতেই তিতকূটে টেস্ট পেল।
-স্যার, মেয়ের কল -- শ্বশুরমশায় অসুস্থ।
-ওহ্ সরি টু হীয়ার দ্যাট। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, হি উইল ড্রপ য়্যু।
-সো কাইন্ড অফ য়্যু, স্যার।
এত রাতে ওলা বা উবের ক্যাবও রিস্কি আজকাল। বসের অফারে উদিতা নির্ভার হল। পার্কিং এরীয়া পর্যন্ত ওকে এগিয়েও দিলেন পলাশ বর্মণ। মদ্যপ হলেও মেয়েদের রেস্পেক্ট দিতে ভুল করেন না ভদ্রলোক এটা উদিতা আগেও লক্ষ্য করেছে।
গাড়িতে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে ক্যাজুয়ালি প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক--
-তুমি তো সিঙ্গল। আচানক মেয়ে আর ইন-ল’স কোথা থেকে এল?
-পরিবর্তন স্যার।
হতভম্ব বসের ভ্রূ-কুঞ্চনকে পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলল।
******
উদিতার মেলোড্র্যামাটিক জীবন-পটের অবিরাম পরিবর্তন গতানুতিক জীবনবোধকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে বারংবার। সমাজ-সংসারকে উপেক্ষা করে দুবছরের ছোট সৌমেন্দুর সাথে প্রেম, লিভ-ইন, বিয়ে, অতঃপর সৌমেন্দু-ময় যাপনের স্বর্গীয় সুখের আস্বাদ এখনও অনুভূতিতে প্রকট। এরই মাঝে উদিতার বাবা-মায়ের মৃত্যু ওর আপাত-শান্ত জীবন নদীতে ঝড় তোলে। সৌমেন্দুর বাবা-মা ওদের মুখ দর্শন করেন না। কিন্তু পুত্রবধূর ধর্মপালনে বদ্ধপরিকর উদিতা শেষ পর্যন্ত তাঁদের মান ভঞ্জন করে নিজেদের কাছে নিয়ে আসে। ভেবেছিল নিত্যকার জীবনের ক্লিশেগুলো সামলে নেবে।
ছ’মাসের মাথায় সৌমেন্দুর সাথে প্রয়োজনের বাইরে বাক্যালাপ বন্ধ, এক বছরের মাথায় সৌমেন্দুর জীবনের নব পল্লবিত প্রেমের কথা জানল উদিতা ওরই কাছ থেকে। শ্বশুর শ্বাশুড়ী নির্বিকার জানালেন পনের বছর আগে উদিতাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে সৌমেন্দু যদি ভুল না করে থাকে তবে আজও ঠিকই করছে।
দু’মেয়েকে রেখেই বেরিয়ে এসে একটা বেসরকারী নিউজ চ্যানেলে জয়েন করে উদিতা। লোভাতুর পৃথিবীতে নিজেকে রক্ষা করাই দুরূহ, মেয়েদের নিরাপত্তা দেবে কীভাবে? তাছাড়া একটা ক্ষীণ আশা, সতীন কন্যাদের উপস্থিতি মেনে নিয়ে অন্যজন আসবে কী?
সৌমেনের বাবা-মা আর তার প্রথম পক্ষের সন্তান নিয়ে সংসার পাততে চায় নি অন্যজন। চার বছর পর অসুস্থ বাবা-মা আর মেয়েদের ন্যূনতম ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না করেই তাই সৌমেন্দু তার প্রিয়তমাকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করে। জানতে পেরে ছুটে যায় উদিতা। ভুলে যায় এই দুই বৃ্দ্ধ-বৃ্দ্ধার কারণে ওর জীবন-নদী জল শূন্য হয়েছিল একদিন।


পরিবর্তনশীল সময়ের দৃশ্যমানতায় উদিতার এই বদান্যতার কথা ধুয়ে যাবে। অমর হবে বাবা-মাকে ছেড়ে উদিতাকে নিয়ে সৌমেন্দুর সংসার করার কাহিনী। তবুও নীলকণ্ঠী সুখাস্বাদনে তৃপ্ত উদিতা।

ঈশানে অশনি সংকেত ---- সুনীতি দেবনাথ

আমাকে তিনি বলতেন
তিনি মানে লাবণ্যলতা গাঢ় গলায়
পটচিত্র চোখ বিস্ফারিত করে
বলতেন
ঈশান কোণে যখন মিশমিশে কালো
দত্যিপানা পাহাড়সারি মেঘ উথলাবে
আর ছলকানো বিজলি
আকাশের বুক চিরে করবে
ফালা ফালা
গাছগাছালি থমকে নিথর
সাবধান সর্বনেশে ঝড় আসবেই |
আজ লাবণ্যলতা হারিয়ে গেছেন
অনালোকিত না ফেরার ঠিকানাহীন কোন ঠিকানায় !
আজ ঈশান ভয়ঙ্কর
সব সংকেত আগুনজ্বালা
নটভৈরব উদ্দাম মাতোয়ারা
কৃষ্ণ ঘনঘটা আকাশজোড়া
বিদ্যুৎ মেতেছে অগ্নিসজ্জায়
মেঘের মিনার ছোঁয়া পাখিদের
ডানা থরথর, একা কাক কাতরায়
ভয়াল আবহে !
এই মহা বিপর্যয়ে ভয়ানক কালে
চারপাশে বিনাশতূর্যের
বিষণ্ণ নির্ঘোষে মহাপ্রলয়ের বার্তা
এখন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত —
এবার আমি কি করব লাবণ্যলতা?

হেই ঝ্যে বাঙালী ---- প্রদীপ্ত দাস

'না দাদা, আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ওরকম বলিনি। অনেকসময় রিস্ক থেকে যায় না! তাই, বাসে একটু দেখেশুনে উঠবেন তো... একবার গেলে, লাইফটাতো চলেই গেলো বলুন...' এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো কন্ডাকটর।
সে কন্ডাক্টরের আরো অনেক দাবী। যেমন বললো, 'ওই যে কানে ইয়ারফোন গুঁজে সব ঘোরে, কান তো যাবেই, সাথে ব্রেন ড্যামেজ হয়ে পাগলাও হয়ে যেতে পারে; আর এক্সিডেন্ট! হলেই ব্যাস। বাপ্-মায়ের রত্ন, স্বর্গে গান শুনবে শালা...' ঠিকই বলেছে কিছুটা। আমার তো শুনে ভালোই লাগলো। আমার পাশে একটা ১৭-১৮ বছর বয়েসী ছেলের কানে গোঁজা ইয়ারফোনের ভলিউমটা বোধ হয় একটু কম ছিল। সে "'coldplay'-আর 'S.O.A.D' শুনি, সব জানি; বেশি শিখিও না" গোছের একটা হাব-ভাব নিয়ে হুব্বার মতো ফিচেল হাসছিলো।
যাক গে, একটু পরে একজন বাসের গতির বিপরীত মুখে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আর কি... কন্ডাকটর বলে, 'দাদা, নিউটনের গতিসূত্র পড়ে বাসে উঠবেন। শালা, শুয়ার। এদের সবকটার বেসিক শিক্ষাটা দিয়ে নিতে হবে আগে।'
আমি ভাবলাম, না, খারাপ না। ঠিকই তো বলেছে। বেশ ভালো কন্ডাকটর। একটু পরেই দেখি, ইয়ারফোন কানে গোঁজা হুৱা নামার জন্যে দাঁড়িয়ে; টাল না ইয়ারফোন কোনটা সামলাবে বুঝতে না পেরে প্রায় পড়েই যায়... এবার কন্ডাক্টরের পালা। সে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে বললো, 'সামলাও, সামলাও। এইবার সামলে নিতে শেখো।'
আরো কিছু পর, বাঁদিক থেকে একটা বাইককে হাত দেখানোর পরেও না দাঁড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে আসায় কন্ডাক্টরের সে কি খিস্তি! কাঁচা... raw... বাসের ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, 'আরে, খিস্তি কোরো না। ওরা যা পারে করবে। পার্টির লোকাল লোক হয় যদি!' কন্ডাকটর বলে, 'পার্টি ফার্টি বুঝিনা দাদা... আইন মেনে বুঝি প্রতিবাদ...'
আমি ভাবলাম, 'বেশ তো। দম আছে মালটার। গুড। বাঙালীর দম। নেতাজির মতো দম। অন্ততঃ ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে দ্বিধা নেই...'
বাসটা গন্তব্যে পৌঁছালো। কন্ডাকটরও নেমে পড়লো। যাত্রীরা সব নামছি... এক যাত্রী প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, 'শালা, কন্ডাক্টরটা শিওর গাঁজাখোর...'। বুঝলাম, 'বাঙালী। পেছনে কথা বলা বাঙালী।'
[আপনারাও বলছেন জানি, "যে লিখেছে সেও 'বাঙালী, ভেবে ভেবে হয়রান বাঙালী']

দুঃখিত ----- দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

সেই কবিতার মেয়েটিকে আমি চিনি না
যাকে ধর্ষণের সময় ও পরে মোবাইলের ক্যামেরা তুলে নিচ্ছিল 
তার স্তনের ক্ষত আর যোনির রক্ত
কিন্তু কিছুতেই তুলতে পারছিল না যন্ত্রণা বাইরের আর ভিতরের
ক্যামেরা ও সঙ্গমকারীর উল্লাস
একটা পাখির বাচ্চাকে খেয়ে নেওয়া
বিড়ালের মুখ ভাবলেশহীন
হীন শব্দটি কাদের পাশে বসবে মেয়েটি ঠিক করে নিক
তার কাছে লুকনো ব্লেড না থাকার
জন্য দুঃখিত কথা লিখি
আর বিশ ফুট উঁচু থেকে নগ্ন মেয়েটি
নামলে
আমি নিজের থেকে পালাতে পালাতে
একটি হীনম্মন্যতার কবিতা লিখি
হাজার বাহবার বন্যায় আমার দেয়াল
ভরে ওঠে
কেউ বলে না
ওকে একটা কাপড় দে রে হারামজাদা

যাই --- লুতফুল হোসেন

ছিন্ন সূতার সীমান্তে তখনো
থমকে থাকে স্তিমিত নাটাই
ইতোচাঞ্চল্যের দ্যোদুল্যমান ঘুড়ি ।
স্তব্ধ দিন কাটুক কি না কাটুক ছাই
সময় গড়িয়ে গেলে স্মৃতির তোরঙ্গ
বুজিয়ে রেখে ব্যস্ত বেলা
অকস্মাৎ অন্তরঙ্গ বলে ওঠে - যাই

চারুলতার বিবর্তন ---- শমিতা চক্রবর্তী

জানলার খড়খড়ির ওপারে চারুলতার একলা দুপুর 
দূরবীন চোখে নিঃসঙ্গতার 
ধূ ধূ মরুভূমি ------

সময়ের হাত ধরে বিবর্তন হয় চারুলতার --- হয়তো কোনো 
সোমলতায় ----------
জানলার কাঁচে তার 
গনগনে দুপুর --- নীরবতা ভাঙে 
সঙ্গীবিহীন কোনো কোকিলের 
ডাক 

বিগতদিনের ব্যস্ততা --সব সেরে 
সে এখন একাকী রত্নগর্ভা হয়েই থাক 

রোজ মুঠো ফোনে চলে কিছু 
কেজো আলাপ 
ঘরের মানুষ ব্যাস্ত বড় , তার ও 
কাজের চাপ 

স্যোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটে খানিক ঘোরাঘুরি সেরে 
ক্লান্ত পায়ে আবার একাকীত্বের 
শৃঙ্খল 

যুগ থেকে যুগ ধরে চারুলতারা 
বদলায় কি ?
শুধু দৃশ্যপট বদলে যায় 
কখনও সোমলতা কখনও বা 
আরও কেউ ----এভাবেই থেকে 

বদল মানুষ --- প্রণব বসু রায়

ন্ধ ঘরে দু'একটি আসবাব সামান্য সরাই
নাইট ল্যাম্পের শেড বদলে দিলে
চেনা ঘর অন্যের গৃহ বলে মনে হতে পারে
তখন বিছানায় বসতে সঙ্কোচ লাগে
আবাল্যের শিক্ষা বসিয়ে রাখে কাঠের চেয়ারে
আমাদের ইচ্ছাগুলি তখন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়
ছিপ রেখে দিই বারান্দার পাশে
আর এ্যাকোয়ারিয়ামে গুঁড়ো খাবার দেবার সময়
সেলফি তুলে রাখি।
কার্তুজের বাক্স মেলে দিই ভেজা চাঁদের আলোয়
ইঁদুরের গর্তে ঢেলে দিই শস্যের দানা
কুয়োতলা সরে যায় কদম গাছের ছায়ায়
আর আমিও দেশলাই কাঠি দিয়ে তৈরী করি রাজার প্রাসাদ
এবং, তারপরে সে দৃশ্য থেকে আর নড়তে পারি না...
#
অথচ আমি এক মাংসাসী প্রাণী
আমার ভ্রমণ পথ সিংহল থেকে সাহারা
প্রিয় খাবারের খোঁজে
আমি অনায়াসে ছাদের পর ছাদ টপকাই
রোজ রাতে ও আংশিক দিনে
রবীন্দ্র সেতু থেকে বিদ্যাসাগর ব্রিজ জুড়ে দিই আলোর মালায়
পুষি রাজহাঁস, শতাব্দী প্রাচীন গাছের গুঁড়িতে ডেরা বেঁধে দিই
#
বিশ্বাস হয় না সামান্য পরিবর্তনে
আমিও কেমন বদল-মানুষ হয়ে যেতে থাকি...

আমাদের যাত্রা --- দীপঙ্কর বেরা

কি যেন একটা দৈর্ঘ্য বরাবর বালুকারেখা
আমি ফেলে আসা দূর সীমানায় কিছু দেখা 

ঢেউ গোনা অবসরে জ্যামিতিক প্রতিচ্ছবি
গলুই ভাবনায় মায়াবী রঙে বিষণ্ণ সবই

দিকচক্রবাল নোঙর ফেলে নি কতকাল
মুহূর্তের হাতে গোনা রহস্য মাপছে রত্নজাল

তোমার শ্বাস আঁকছে দিগন্তের অজেয়বাদ
আমি তাই অনাবিল নদী চর বাদানুবাদ

যে বেঁধেছে সেও ভেসে যাবে মোহনায়
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নৌকো ঐ দেখা যায়

রিটার্ন গিফট ---- শঙ্খসাথি পাল

সমুদ্র.... বরাবরের পাগলামি রাই-এর সমুদ্রকে ঘিরে ।অথচ বিয়ের পর থেকে রচিত একবারও সমুদ্রে বেড়াতে নিয়ে আসে নি ।প্রতি বছর শুধু পাহাড় আর পাহাড় ।পাহাড় রাই-এর অসহ্য লাগে।রচিত কি করে সব ভুলে গেল কে জানে ।হিয়াকে তো রচিত পাগলের মত ভালোবাসতো, সেই হিয়াকেই পাহাড় কেড়ে নিল - তবু কিসের টানে রচিত বারবার পাহাড়ের কাছে ছুটে গেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পায় না রাই ।এই প্রথমবার, বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে সমুদ্রে নিয়ে এসেছে রচিত ।
ধ্যাত.. কিচ্ছু ভালো লাগছে না ।দুপুরে পৌঁছেছে তাজপুর ।সারা বিকাল ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল রচিত ।এদিকে সমুদ্র পাগলের মতো টানছে রাই-কে ।নাহ, একাই বেরিয়ে পড়ল রাই, বেডসাইড টেবিলে রচিতের জন্য চিরকুট রেখে গেল ।
পায়ে পায়ে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে বিশেষ সময় লাগলো না ।তাজপুরে লোকজন খুব কম ।শান্ত বালুচরে শেষ বিকেলের সোনালী রোদ্দুর মেখে আছড়ে পড়ছে ঢেউগুলো ।মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।কত কী ভেবেছিল সে - সন্তান হলে নাম রাখবে ঢেউ ।অথচ আজ বিয়ের পাঁচ বছর পরও সে মা হতে পারলো না ।সমস্যা তারই - সে গ্লানি কুঁড়েকুঁড়ে খায় প্রতিনিয়ত ।যদিও রচিত কখনও তাকে কোনো দোষারোপ করে না ।হঠাৎ ভীষণরকম রাগ হতে লাগলো রাই-এর, রচিতের ওপর নিজের ওপর ।এই রচিতকেই সে পাগলের মতো ভালোবেসেছে জ্ঞান হয়ে থেকে, এই রচিতের অবহেলা সহ্য করেছে দিনের পর দিন, চোখের সামনে থাকে তার যমজ বোন হিয়ার হতে দেখেছে, আবার তাকে পাওয়ার অদম্য নেশাতেই সেবার হিয়াকে সবার আড়ালে পাহাড় থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ফেলে দিয়েছে ।অথচ কী পেয়েছে ?! হ্যাঁ, হিয়ার মৃত্যুর কয়েক বছর পর দুইবাড়ির লোকজনই রচিতের সাথে রাই-এর বিয়ে দেয় ।কিন্তু রচিতকে পেয়ে কী আদৌ সুখী হতে পেরেছে রাই?! পারে নি, পারে নি ।কিসের যেন অতৃপ্তি তাড়া করে বেড়ায় সর্বক্ষণ ।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এসেছে ।দূরে একটা পরিত্যক্ত নৌকা ।আচমকাই তার আড়াল থেকে রচিতকে বেরিয়ে আসতে দেখে রাই ।দুজনে মিলে সেই নৌকায় গিয়ে বসে ।সূর্যাস্তের আলোয় মুগ্ধ রাই ।রচিতও আজ যেন অন্যরকম মুডে, অনেকদিন পর ।নৌকার গায়ে খোদাই করছে আজকের তারিখ ।রাই-এর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে নিজেই বলে রচিত ,-"চিরস্থায়ী হবে আজকের সন্ধ্যা ভালোবাসার নামে "।রাই ভেসে যায় আবেগে ।
খানিকক্ষণ পর রাই-কে নিয়ে সমুদ্রে নামে রচিত ।জোয়ার এসেছে সমুদ্রে তখন, ক্রমশ বাড়ছে ঢেউ এর উন্মাদনা ।রচিত রাই-কে নিয়ে যাচ্ছে আরও ভেতরে.... 
-রচিত, আর যেও না, ভয় করছে ।
-কেন রাই, সমুদ্র তো তুমি ভালোবাসো! 
-কিন্তু ভয় করছে রচিত ।
-হিয়াও সেদিন এমনই বলেছিল তোমায়, তাই না রাই?! 
-মা-আ-আ-নে...?! 
-তোমায় গুরপ্রীতকে মনে আছে? সেবার হিমাচলে আমাদের গাইড ছিল! সেদিন আমার অফিসে এসেছিল ।হিয়ার হ্যান্ডিকমটা ফেরৎ দিতে ।আমরা তো ডেডবডি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম, গুরপ্রীত কুড়িয়ে পেয়েছিল হ্যান্ডিকমটা ।রেখে দিয়েছিল যত্ন করে, কখনও কোলকাতায় এলে ফেরৎ দেবে বলে... ।
-আমায় মেরে ফেলো না রচিত.... 
-হ্যান্ডিকমের রেকর্ডিং - এ হিয়াও ঠিক এভাবেই বাঁচার আকুতি করছে রাই তোমার কাছে... 
-আমার ভুল হয়ে গেছে.. ক্ষমা করো.... 

চারিদিকের নিস্তব্ধতা খান খান করে রচিত হাসছে পাগলের মত ।দু'টো শক্ত পুরুষালি হাত চেপে ধরে থাকছে রাই-কে ঢেউ-এর গভীরে ।ক্রমশ ছটফটানি কমে স্থির হয়ে আসছে রাই.... 

আকর্ষণ ----- সিলভিয়া ঘোষ

ছুঁয়ে যাচ্ছ তুমি 
বারে বারে তোমার উষ্ণতা মাপছি
ভেসে যাব না ঠিক করেও উতপ্ত
বালুরাশি ভেদ করে তোমার উদ্যত ঊর্মিমালার আকর্ষণে চৌম্বক বলয়ে
প্রবেশ করে চলে যেতে চাই আজি

হারিয়ে যেতে চাই একাকি আমি 
তোমার গভীর বুকে সুখ দুঃখের নাও 
ভাসিয়ে দেব প্রতিজ্ঞা করেছি 
অমূল্য আকর্ষণের নাম দিয়েছি মন মাঝি 

একলা ---- ব্রততী সান্যাল

উজান স্রোতে বৈঠা বেয়ে পড়ন্ত হয় সদ্যজাত ভোর, 
নীলাভ ঢেউ-ভাঙা সশব্দ ধারায়
কাঙ্খিত মোহনার কাল্পনিক পরিসর ছুঁয়ে, 
ছলাৎ শব্দে বয়ে চলে শ্রান্তিহীন নদী.. 

ভাঙা সাঁকোর ওপারেও দুপুর নিঝুম হয়, 
উষ্ণতার ছাঁচে রঙ বদলায় চেনা আকাশ.. 
ঝাউগাছের ফাঁকে বাসা বাঁধে নির্বিবাদী মেঘ, 

পালবিহীন নৌকা উপকূল ঘেঁষে পড়ে থাকে, 
সীমাহীন সুদূরে তার ভাসার ছিল বুঝি, 
বুক ভরে নেওয়ার ছিল দেশান্তরের শ্বাস.. 

নিরুদ্দিষ্ট মাঝির অবয়ব ছায়া ফেলে না দিনান্তে, 
শিশিরভেজা সকাল-রোদেও দেখা যায় না পদচিহ্ন, 
পরিত্যক্ত পাটাতন জোৎস্নাস্নাত বিন্যাসে পড়ে থাকে.. 

মুহূর্তে মুহূর্ত জুড়ে অস্তরেখা সুস্পষ্ট হয়, 
রাখালের মায়াবাঁশির সুর আপনিই থেমে যায়, 
নোঙর তবু তোলা হয় না.. 
বেঁচে থাকে আপাত ঘোলা জলছবির উপান্তে
সঙ্গীহীন নৌকার অঘোষিত উপন্যাস.. 

একা --- শুভশ্রী সাহা

একলা থেকে গেছে কেউ কেউ গভীরে,
সমুদ্র যেমন রেখেছে বিষাদ বিস্তারে,
ঢেউ চিহ্ন রাখেনি, লেপটানো সিঁদুরের
শুধু ভেঙেছে কত ভেতরে, ভেতরে।
থেকে গেছে কেউ কেউ , বিষন্ন, একা,
সকালের ক্যকোফোনি, পেরিয়ে দূর দূর ভাসা,
জেলে নৌকায় থেকে গেছে পোড়া সিগারেট
আজ কিছু নেই, শুন্যতা ছাড়া.

মানবতা ---- লীনা রায়চৌধুরী

আত্মীয়- পরিজনদের সাথে বিশেষ কোন যোগ উপলক্ষে নদীয়া জেলার করিমপুরে গিয়েছিলাম ।
জলঙ্গি নদী-পাশেই 'ভবা পাগলার"আশ্রম।গান পাগল-সিদ্ধযোগী-অহম্ বোধ হীন।অগণিত মানুষ নৌকা ভাড়া করে,কেউবা পারানি নৌকাতে এসে জমায়েত উৎসব প্রাঙ্গণে ।কৃষ্ণনগর, তেহট্ট, পলাশী-চারিদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত পুণ্য স্নান এবং পুণ্য উৎসবে যোগ দিতে।উৎসব আশ্রমের একটা ঘর বিশেষ পরিচিতি থাকার জন্য আমরা পেয়েছিলাম ।বর্ষা ঋতু,নদীর জলের স্ফীতি এমনিতেই বেশি ।তারপর সারা বছর শুকনো থাকা এইসব নদীর নব্যতা কম।জলের প্রচণ্ড স্রোত! গেস্ট হাউসের নিচেই নদীর ঢাল এবং ছোট একটা পার মতো।কিছু কিছু নৌকা এসে দাড়াচ্ছে 
সকাল থেকে দেখছি গেস্ট হাউজের ঠিক নীচে নদীর জল ঘেঁষে একটা ছোট নৌকা।একটু নজর করতে দেখি ,একজন মহিলা শুয়ে আছেন ।জানতে পারলাম উনি অসুস্থ ।পরিবার বা প্রতিবেশীরা ওনাকে ছেড়ে পুণ্য অর্জনের আশায় উৎসবে মত্ত ।পাশ দিয়ে শত শত পুণ্যকামী যাচ্ছে, কিন্তু কেউ ওনাকে ছুঁয়ে দেখা দূরঅস্ত ,
তাকিয়েও দেখছে না।হয়তো সেই মানুষ টা কি জাত,কোন বর্ণের এই নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব আছে ।যেটা মানবতা থেকে অনেক বড় ধর্ম!
একটা কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল নদীতে জল বাড়ছে ।সবার মধ্যে একটা চাপা উৎকণ্ঠা ও ছিল।দুপুরের দিকে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল ।যেন কোন অশনি সংকেত! পলকেই দেখলাম ছোট একতলা বাড়ি সমান উচ্চতায় জল ছুটে আসছে, প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে।জলচ্ছাস!জলচ্ছাস!তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা জলের তোড়ে দুভাজ হয়ে গেল ছোট নৌকাটা।চারদিক জলে উথাল পাতাল ।
বিপর্যয়ের রাত ও একদিন শেষ হয় নতুন সূর্যের আগমনে।চারদিকে জল আর জল।মন্দিরের অনেকটাই ডুবে আছে জলের তলায় ।গেস্ট হাউসটা নিরাপদে উচ্চতার জন্য ।দিগন্তের কাছে ডাজ হওয়া ডাঙা নৌকা টা ভাসছে ।সেই অসহায়- অসুস্থ মানুষটা হয়তো হারিয়ে গেছে মানব-ধর্মের বিপুলতার মধ্যে!!

ব্যথার পূজা ----- শ্রীলেখা মুখার্জ্জী

মনের একান্ত প্রান্তরে হাহুতাশ
এক আকাশ সম্মোহনী নিঃসঙ্গতা---
'
নিবিড় ব্যথাগুলির আহুতি-যজ্ঞ
বিষণ্ণনতার ধিকিধিকি আঁচে,
ভস্মীভূত ধূসর আস্তরণ ঢেকে দেয়
সুসজ্জিত যাপন-সরণী--
'
পুর্নজীবন প্রাপ্ত ফিনিক্স পাখি
গভীরতর দুঃখ বুকের সংগোপনে,
খড়কুটো গোঁজা আশিয়ানায়
কষ্টের রঙে আলপনা আঁকি
অমৃত কলসে রাখি স্মৃতি-পল্লব --
'
অশ্রু ধোয়া ম্রিয়মান বেদনার
নৈবেদ্য সাজাই আজানের গোধূলিতে
সমাপ্তি থেকে উৎসারিত বিচ্ছিন্নদ্বীপে
আমার ব্যথার পূজার সন্ধ্যারতি--

রূপান্তর ---- সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ধবধবে ফর্সা, টান টান শরীর, চোখে চিরসঙ্গী চশমাটির সাথে সাদা হাফ সার্ট আর ফুলপ্যান্ট পরিহিত পঙ্চাশোর্ধ দীপন সাইকেল নিয়ে ঢুকলো স্কুলে ।স্কুল মাস্টারিতে তার কোন কৃপণতা না থাকলেও ছাত্র ছাত্রীদের কাছে কিপটে দীপন বলে পরিচিত ।বাজারে প্রয়োজনে অধিক জিনিস তাকে কেউ নিতে দেখে নি কোনদিন ।তার দুই ছেলেই হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসে ।সাইকেল চাইলে বাবা বলেন, এখনো সময় হয় নি, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো।সে কথা শুনে ঋক আর ঋজু মন খারাপ করে থাকে ।

বন্ধুরা হাসে ।ওরা সেখানে দাঁড়ায় না ।এগিয়ে যায় নিজের ক্লাসের দিকে ।ওরা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ।বন্ধুদের মতো ওদের হাতে মোবাইল নেই ।টিফিন ক্যান্টিনে খাওয়ার না খেয়ে ওরা মার দেয়া খাবার খায় ।প্রথম দিকে কষ্ট হলেও এখন ওরা জানে মানুষ না হলে, ভালো লেখাপড়া করে বড় না হলে এই কষ্ট যাবার নয় ।

সেদিন পরীক্ষার পর বাবার সাথে ঋক আর ঋজু চিড়িয়াখানা ঘুরতে এসেছিল ।খুব মজা করেছে ওরা ।ট্রেনে আসার সময়ে অনেক কিছু খেয়েছিল আর এখন সুন্দর হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে ট্রেনে এসে বসেছে ।মনে ভালোলাগা নিয়ে দুই ভাই চোখ রাখে ট্রেনের বাইরে প্ল্যাটফর্মের দিকে ।দীপন তখন খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত ।প্রচুর ভীড়ের মাঝে ওদের চোখ এক অন্ধ ভিখারিনীর দিকে ।হাতে লাঠিটা নিয়ে সে এগিয়ে চলে তার সাথে এগোতে থাকে সরল ও নিস্পাপ দুজোড়া চোখও। সাহস ঋক বাবাকে বলে, দুটো টাকা দাও না, ভিক্ষা দেব ।
-কি দিবি? দীপনের চোখে বিরক্তি ।
-ভিক্ষা ঐদেখো . . 
বাচ্চাদের চোখ দুটিকে অনুসরন করে দীপনের চোখ যায় ভিখারিনীর দিকে ।আলুথালু বেশ ও কেশ ।পরনে ময়লা , পুরনো শতছিন্ন একখান শাড়ি ।বাঁ হাতে একখানা লাঠি ডানহাতে বাটি, যা মাধুকরী একমাত্র সম্বল ।পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো কয়েন বের করে ছেলেদের হাতে দিতে ওরা বাটিতে দিয়ে খুশি মনে বসে ।আবারও ওরা চোখ রাখে বাইরে, দীপন অন্যমনস্ক হয়ে যায় ।

ঠং শব্দে চোখ যায় ভিখারিনীর দিকে ।হাতের লাঠিটা ঠং করে পড়লেও গড়িয়ে দূরে চলে গেছে খানিকটা ।ব্যস্ত মানুষের কারোর সময় নেই লাঠিটা তুলে দেওয়ার ।দীপনের চোখ আটকে গেলো ঘটনার উপর ।দেখে সেই মহিলা হাতড়ে বেড়াচ্ছে লাঠিটাকে।আশ্রয়টাকে আঁকড়ে ধরার প্রবল আকুলতা তার ।দীপনের চমক ভাঙে, ছেলেদের বলে, আমি আসছি, দিদিটা সত্যিই অন্ধ রে ।
দীপন নেমে আসে ট্রেন থেকে ।অনায়াসে উঠিয়ে দেয় লাঠিটা ভিখারিনীর হাতে ।পার্স থেকে একটি পঙ্চাশটাকার নোট দিয়ে বলে, দিদি এটা রাখুন ।

বাবার এই আকস্মিক পরিবর্তনে ঋক ও ঋজু আনন্দিত ও বিস্মিত ।ঋক ফিসফিস করে বলে ঋজু কে , আমাদের বাবা কিপটে নয় রে ভাই ।
-তাহলে কি? 
-মিতব্যয়ী ।ঋজুর সর্গবে উত্তর দেয় ।

পরিবর্তন ---- দূর্বা মিত্র

২০১৭-- মানে পৃথিবীতে আসার অর্ধ শতাব্দী পার করে ফেললাম | 
পরিবর্তন কি কি দেখেছি তা তো এই পরিধি তে শেষ করা যাবে না | আমার মনের কোনো গহন গোপন কোণে অন্য কিছু কামনা বাসনা লুকিয়ে আছে -- যে ক্ষেত্রে হয় আমার অন্দরে বা বাহিরে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তনের আকাঙ্খায় থেকে গিয়েছে --সেটা খুঁজে দেখি !

হ্যাঁ একটা তো এখুনি মনে পড়ছে | ১৭ বছর বাইরে থেকে কলকাতায় যখন ফিরে এলাম, যাদের যেখানে যেমন ছেড়ে গেছিলাম -- খুঁজে পেতে তাদের যোগাযোগ উদ্ধার করলাম ---মনে খুশির জোয়ার নেমে এলো |

দু কান এঁটো করা হাসি আর জায়গা মতো মিষ্টি বা ফুল বা চকলেট নিয়ে --- গুচ্ছের পেট্রল খরচ করে -- প্রাণ জল করা গরমে আর জ্যাম এ গাড়ি চালিয়ে -- পৌঁছতে লাগলাম ভুলে যাওয়া ঠিকানা গুলোতে |
হা ঈশ্বর ! 
এরা সব কারা ? চেহারা পরিবর্তন নাই বা নজর করলাম --- কিন্তু মন ? কি ভাষায় কি কথা বলছে --আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকছে না যে ! নানাবিধ বাংলা বা হিন্দি সিরিয়াল--- তাদের চরিত্র নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত ! আগামীতে তাদের জীবনে কি ঘটবে --- সেই নিয়ে আশংকিত বা আশান্বিত |
আমি জীবনে চা বিসকুট তেলেভাজা মিষ্টি সমন্বয়ের জন্য লালায়িত নই-- সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সেগুলোই আমাকে জোর করে খাওয়াবেই | ফল দুধ লস্যি--এইসব জিনিস চাইলে আকাশ থেকে কেন পড়ে ?

না থাক | শুধু কষ্ট বাড়া ছাড়া আর কোনো উপকার হবে না | এই সব পরিবর্তিত পরিচিতরা আমার পরিবর্তন হয়তো হজম করতে পারছে না |

আমি বরং ফিরেই যাই --- আমার নিজস্ব পরিমণ্ডলে -- যার পরিবর্তন আর পরিবর্ধন আমার নিজস্ব কর্তৃত্বাধীন |

তথাকথিত আত্মীয়তা বা বন্ধুত্ব রক্ষা আমার ক্ষমতায় কুলোবে না | তারা সবাই নিজস্ব বৃত্তে ঘুরতে থাকুক --- পরিবর্তন এক পাক ঘুরে আবার নিজের জায়গায় ফিরুক ---আমি চললাম |

মাস্তুলে মৌসুমি হাওয়া ----- বিলকিস বি পলি

পরিবর্তনের চাকায় পিষ্ট হয়ে
বর্তমান অতীত হয়ে কাঁদে
অথচ স্রোতের মতো বয়ে চলা সময় 
ফিরে তাকায়না একটিবার
অচেনা পথিক হয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলে
দূর থেকে হাতছানি দেয়া ভবিষ্যতকে 
আপন করে নিতে

এই ঘোরলাগা পরিবর্তনে 
মানুষগুলোও খোলস পালটায়
যার ব্যতিক্রম নই আমিও
আমিও পাল্টে ফেলতে চাই নিজেকে
এই মানুষ থেকে হতে চাই অন্য মানুষ 
ছেটে ফেলতে চাই বাড়তি নখের মতো 
কষ্ট দেয়া অনুভূতিগুলো

নিরহংকারী নত মস্তক 
উদ্ধত করতে চাই আত্মমর্যাদায় 
যা বিকিয়ে দিয়েছি অন্যায় আবদারে
দেরাজে বন্দী থাকা অভিমানগুলো
খুলে খুলে দেখতে চাই 
কতটা ধুলো জমেছে তাতে
দেখতে চাই শ্বাপদ দানবের নখের আঁচড়ে
কতটা এলোমেলো হয়েছে পেলব হৃদয়

নৈঃশব্দ মাঝরাতে দুঃস্বপ্নে জেগে ওঠা ক্লান্ত চোখ
তারার আলোয় পথ খুঁজে খুঁজে অবশেষে
ভোরের আলোয় সূচনা করে ব্যস্ততম দিনের
বদলে যায় সময় ও জীবনের পটভূমি 
বদলে যায় নিজ হাতে গড়া সম্পর্কগুলো

জীবন মাস্তুলে লাগা এই পরিবর্তনের হাওয়ায়
আপাত দৃষ্টিতে বদলে গেছি মনে হলেও
আসলে কি পরিবর্তন হয় 
স্মৃতিপথে বারবার হেঁটে বেড়ানো 
আমাদের অন্তরাত্মার
দিনের আলোয় ঘুমিয়ে থাকলেও
রাতের একাকীত্বে জেগে উঠে যে
পাড়ি জমায় স্মৃতির পাতায়

কয়েকটা লাইন মাত্র --- সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

নারী হয়েও, কয়েকটা লাইন লিখছি আমি
নারী হয়েও, সলিঙ্গ থিওরি থেকে আসামী
:
নারী মানে একটা নদী, নারী মানে ঝরা কুসুম
নারী মানে পাতাবাহার, নারী মানে অন্তরঙ্গ ঘুম
নারী মানে স্বরবিতানের দোমহনা
নারী মানে প্রতিবিম্ব উড়বে না
:
নারী মানে মাইক্রোচিপস, তুলতুলে তৃণলতা
নারী মানে আনারদানা, নীল অপরাজিতা
নারী মানে, দশমিক অঙ্কের সরগম শিস
নারী মানে, হার্ডডিস্কের ইচ্ছাপূরণ মিস 
:
নারী মানে ধূপছাও টুপির উদ্যান, আধখানা রোদ্দুর
নারী মানে স্বরলিপি, আষাঢ় মাসের শেষ দিনে ঘুঙুর
নারী মানে, পুতুলনাচের আস্ত ঝরোকা
নারী মানে, টুকরো রাতের ফোয়ারা মাইকা
:
নারী মানে সেরামিক চন্দ্রমল্লিকা, ঢাকাই জামদানি
নারী মানে সাঁতারকেন্দ্র, ওগো নখরজ্ঞনী
নারী মানে, চিলেকোঠার সুন্দর মুখশ্রী
নারী মানে, ফেরিবোটের হুইলকুর্শি
:
নারী মানে, দূরবীক্ষণের ভুল দিকে দাঁড়িয়ে
নারী মানে, সর্বংসহা ভাস্কর্যের সঙ্গমে হারিয়ে
নারী মানে, শূন্যতাও দেখতে যদি পাও
নারী মানে হারিয়ে গেলে, ভাষাহীন হও

নারী – আমাদের জীবনের রস এবং মাধুর্যের একমাত্র উৎস --- সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

সিন্ধুসভ্যতার যুগ থেকে আধুনিক ভারতে মাতৃশক্তি পূজিত হয়ে চলেছে । আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ও সমস্ত আর্য অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে ধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ ছিলো শক্তি উৎসরূপে মাতৃদেবতার পূজা । একসময়ে আদিম মানবের ভাবনায় এসেছিলো , শুধুমাত্র নারীর বুকেই স্তন্যক্ষীরধারা প্রবাহিত হয় কেন ? নারীর মধ্য থেকেই নতুন জীবনের সূচনা হয় কেন ? জন্ম নেয় এক নতুন মানব ! আদিম মানুষেরা ছিলো প্রকৃতির খেলার বস্তু । প্রকৃতির খেয়াল এবং প্রকৃতির দুর্যোগকে তারা ভয় পেত । তখনকার সেই রুক্ষ, রসহীন, মাধুর্যহীন জীবনে রস ও মাধুর্যের একমাত্র উৎস ছিল নারী । তারা নারীর কাছে পেতো স্নেহ, মমতা, মানসিক ও শারীরিক আশ্রয় এবং আনন্দ । তারপর আদিম সমাজ যখন কৃষি নির্ভর হয়ে পড়লো তখন বীজবপন থেকে শস্য-সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে নারীই ছিলো অগ্রণী । এতে নারী হয়ে উঠেছিলো পরিবার তথা গোষ্ঠীর প্রধান । যখন বিবাহ সম্পর্ক প্রবর্তিত ও স্বীকৃত হয়নি সমাজে তখন স্ত্রীপ্রাধান্য ছিলো । নারী ছিলো স্বাধীন । মায়ের পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় চিহ্নিত হতো । বিবাহ সম্পর্ক প্রবর্তিত ও স্বীকৃত হবার পর মানব সমাজে ক্রমে ক্রমে পুরুষপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে । ধনসম্পদ পুরুষের অধিকারে আসে । পুরুষের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হতে থাকে নারী ।

নারী তারপর থেকে ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকে এই পুরুষপ্রাধান্য সমাজে । তাঁরা নানা ভাবে লাঞ্ছিত হতে থাকে পুরুষের কাছে । বর্তমানে সেই নৃশংসতার বহর প্রতিনিয়ত চূড়ান্ত ভয়াবহতার বাঁধ ভাঙছে । বর্তমানে নারীরা বাড়ির বাইরে পা রেখেছে । আজকের নারী লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজনের পরিধি ভেঙে বেরিয়ে বেরিয়ে এসেছেন শুধুমাত্র সংসার এবং পেটের দায়ে । শিক্ষিত মহিলা কম্যান্ডো , পাইলট, মহাকাশচারী , ইঞ্জিনিয়ার , ডাক্তার , জজ ম্যাজিস্ট্রেট , স্কুল-কলেজের শিক্ষিকা , রাজনৈতিক নেত্রী ইত্যাদি হয়েছেন । এই নারীই স্টেশনে এবং ট্রেনে হকারি করছেন , বাজারে সবজি বিক্রি করছেন , গৃপরিচারিকা , রাঁধুনি ইত্যাদি পেশা বেছে নিয়ে নিজেদের সংসার সামলাচ্ছেন এবং সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ তৈরি করছেন ।

এতো কিছুর পরও লিঙ্গবৈষম্যের ফেরে কর্মক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও নারীর পিছিয়ে পড়া চোখে পড়ছে বর্তমান বিশ্বে । সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ পায় যে , কর্মক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম বেতন পান । তবে বর্তমানে অনেক নারী সমস্ত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই ছাড়ছেন না । এরাই আজকাল বাল্যবিবাহ রুখে চলেছেন যা হয়তো নারী দিবসের এক আন্তরিক পাওয়া । 

আজ এই নারী দিবস পালন করার সাথেসাথে আমাদের হয়ে উঠতে হবে একজন প্রকৃত মানুষ । ঝেড়ে ফেলতে হবে নারী পুরুষের বাহ্যিক আবরণ । নারী এবং পুরুষ - উভয়ের মধ্যে বিশ্বাস থাকাটাও খুবই জরুরী । সেই বিশ্বাসেই নারীকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার বস্তু বলে মনে করবে না কোনো পুরুষ । পণ প্রথা নামক সামাজিক কুসংস্কারের বলি হয়ে প্রাণ দেবে না কোনো নারী । বাসে ট্রেনে ট্রামে পুরুষের কদর্য ইঙ্গিত এবং ব্যবহারের সন্মুখীন হতে হবে না নারীকে । নারী বাজারে বিকোবে না সস্তার পণ্য হিসেবে । বন্ধ হোক বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা । আমরা ভুলে যাবো কেন এই নারীই কিন্ত পুরুষের স্নেহ, মমতা, মানসিক ও শারীরিক আশ্রয় এবং আনন্দের আঁধার । নারীই আমাদের সমাজ ও জীবনের শ্রেষ্ঠ স্থপতি । 

আলাপ প্রলাপ এবং শব্দের বিভ্রম ----- রিক্তা চক্রবর্তী

দীর্ঘ এক দশক পর প্রতিবাদী মননের মৌন বিলাসে 
ফেলে আসা সাঁঝের আতর গন্ধ মেখে ফিরে এলাম
:
সম্ভাব্য যতিচিহ্ন নয় 
বরং দেশ ছাড়ার আগে আজানের সুরে পরিবর্তনের সুর খুঁজেছিলাম
:
আজও তাই 
অপ্রেমে অগভীর সন্ধ্যায় স্পর্শহীন সে ওঠা নামায় 
বৈরীতা খুঁজে চলি 
:
দীর্ঘ পথ হাঁটার পর 
এখন সময়কে গর্ভিণী করি নিত্য অভিলাষে 

পটভূমি পাল্টানোকে দূর্বোধ্য স্বরাভাসে ব্যক্ত করি 
সম্পর্কের অকাল ভাসান বুঝিয়ে দেয় 
বিগত স্পর্ধার কোন নিরাময় নেই 

বদল ---- চন্দ্রিমা গুপ্ত

দ্বিরাগমন থেকে ফিরে আসার পর দিনই প্রাতরাশের টেবিলে শীলার নজর এড়ালোনা, ছেলের বউ রিন্কুর ডান হাতে কিছু নেই বা হাতে ফ্যান্সি লোহার বালা যেটা শীলাই পছন্দ করে কিনেছে:গয়নাগাটি সব খুলে রেখেছে মেয়েটা!কপালটাও খালি ,জিন্স টি সার্ট পরে কাঁধে লেদার ব্যাগ ঝুলিয়ে একেবারে কুমারী মেয়ে!মেয়েটাকে বলতে হবে এখনি এভাবে দেখলে পাড়ার লোকে নিন্দে করবে:শীলা যে নিবিড়ভাবে রিঙ্কুকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে ওর সেদিকে খেয়াল নেই:বহু রকমের ব্রেকফাস্ট আইটেম ছেড়ে ফলের রসের গ্লাসটা তুলে নিল ও, এক চুমুকে প্রায় শেষ করে উঠে দাড়ালো দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল,"আমি বেরোচ্ছি,আজ একটা সিরিয়াস অপারেশন আছে সিনিয়রদের সঙ্গে থাকতে হবে,তাড়াতাড়ি ফিরব,বাড়ি এসে লাঞ্চ করব:" শীলা হাত দেখালো:দেখল কিনা কে জানে!গাইনো সার্জেন বৌমা এগুলি তো মানিয়ে নিতেই হবে মনে,মনে ভাবলো শীলা:
সারাদিন কাজ করতে করতে ভাবতে থাকলো শীলা কথাটা বলতেই হবে কিন্তু কিভাবে বলবে কিভাবে নেবে মেয়েটা:
দখ্যিন কলকাতার একটা অভিজাত পাড়ার বহু দিনের বাসিন্দা শীলারা :এই বছর এখানকার মহিলা ক্লাবের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছে ও,নির্বাচনে জিতেই পদটা পাওয়া তবু অনেকের পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা,শীলর কানে আসছে নানা নেতিবাচক কথা যদিও শীলা এসবে পাত্তা দেয় না,ওর মতে ভালো কাজ করে দেখাতে পারলে কারোর কিছু বলার থাকবে না কিন্তু এখন বেশ চিন্তায় পরেছে ও,রিঙ্কুকে এভাবে দেখলে সমালোচনার ঝড় উঠবে:এই অভিজাত পাড়াতেও কিছু মহিলা আছে যারা বাইরে থেকে আধুনিক কিন্তু মানসিকতায় পুরাতনী আমেজ বয়ে বেড়াচ্ছে!রিঙ্কু মেয়েটা পরিছন্ন মানসিকতার,বুদ্ধিমতিও ;শীলা বেশ ভালো বেসে ফেলেছে এই কদিনেই মেয়েটাকে:পছন্দের ব্যাপারে নিজের ছেলের তারিফ করতেই হয়:ওকে কেউ কিছু বললে শীলা নিতে পারবে না:কথাটা বললে মেয়েটা কষ্ট পাবে না তো !নানানটা ভাবতে ভাবতে সময় কেটে গেল:
দুপুরে খেতে খেতে কথাটা বলেই ফেলল শীলা,রিঙ্কু শুনলো ওকে একটু বউ বউ দেখায় এমন করে সেজে থাকতে বলছে শ্বাশুড়ি মা:রিঙ্কু চুপ করে থাকলো:শ্বাশুরিমাকে ওর খুব ভালো লাগে,অন্তত বন্ধুভাবাপন্ন যে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই:
রবিবার শীলা মহিলা ক্লাবের সবাইকে দুপুরে নিমন্ত্রণ করেছে:যথা সময়ে হই হই করে সব এসে হাজির:ঘরে ঢুকেই বৌমাকে দেখার জন্যে ব্যস্ততা!শীলা একফাঁকে গিয়ে রিঙ্কুকে ডেকে এলো:ও ঘরে ঢুকতেই সবাই অবাক,এ কি সাজ মেয়েটার!কপালে ইয়া বড় সিদুরের ফোঁটা লাল পাড়ের শাড়ি পরা,মাথায় ঘোমটা!এই প্রজন্মের এক ডাক্তারনী মেয়ের একি সাজ!প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো ওরা আমাদের বৌমার সাজ পরিবর্তন করতে হবে এভাবে আটপৌরে সাজে একদম গাইয়া লাগছে:রিঙ্কু দেখে নিয়েছে শ্বাশুড়ির বান্ধবীদের পরনে আধুনিক পোশাক:রিঙ্কু সকালের তোলা সেল্ফিটা দেখিয়ে বলল এটা চলবে?একজন সজোরে বলে উঠলো" একদম এটাই":অন্যদেরও একমত: ...
রিঙ্কু শিলার দিকে তাকিয়ে বলল," এভাবেই পরিবর্তন আনতে হয় মা" তারপর হেসে উঠলো ,শীলা রিঙ্কুকে জড়িয়ে ধরলো:যদিও ওরা সবাই চলে যাওয়ার পরে কথাটা বলেছিল রিঙ্কু । 

বিবর্তন ----- জাকিয়া জেসমিন যূথী

মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে দোল খেতে খেতে 
বিস্তার ঘটে ভাবনার, ইচ্ছে অনিচ্ছের
তার বিচ্ছুরণ প্রকাশ পায় বিভিন্ন আচরণে
.
হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ে বয়েস, ডালপালা ছড়ায় সুখ
ঘর হতে বাড়িয়ে পা, দেখি চারপাশের পরিবেশ
গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে, এথায় ওথায় বাহাদুরি
.
এরপর শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরের অদম্য আকাশ
এ পাড়াটা পেরোলেই সামনে বিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ
আসলে বিপদ উদ্ধার করে নেবে অচেনা রাজপুত
.
কল্পনার রাজ্য থেকে রঙ ফিকে হতে থাকে তারুণ্যে
পাওয়া না পাওয়া, ইচ্ছের পাখিরা সুখের খোঁজে অদম্য
কল্পনাকে ভর দিয়ে উড়ে চলি দূর দূরান্তে বাঁধাহীন দূরন্ত
.
যৌবনে বসে বুনি ভবিষ্যত সুখ স্বপ্নের রঙ্গিন খাঁচা
পাশে খুঁজি শক্ত অবলম্বন যার কাঁধে রাখবো বৃদ্ধ মাথা
দু জোড়া হাত কাঁধে বেঁধে কাঁধ পাড়ি জমাবো অচিনপুর
.
এভাবে একের পরে এক পরিবর্তন নতুন নতুন পথে ধাবমান
জীবন শেখালো অনেক কিছু, দিলো অনেক অনেক জ্ঞান
এভাবেই কেটে যায় নিয়তি, ধরার নিয়মে জীবন বহমান 

অলক্ষে বদলে গেছে ঋতু ---- জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী

প্রেক্ষাপট :
চাদরের ভাঁজে বসন্ত সাজিয়ে ঘুমিয়েছে শহর
নকশা বোনা সূঁচের ডগায় ছাপোষা নীল সুতোর কনসেপ্ট তুচ্ছ করে
আত্মকেন্দ্রিক কবি নিমেষেই পৌঁছতে চাইছে পলাশরঙা ভোরে
:
নক্ষত্র সাজিয়ে রাখছে শিশু নক্ষত্রের আকাশ
আর জারজ'দের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে সীমাহীন ছায়াপথ
:
রিভলিউশন ঘেঁটে আগামীর কথা বলছে না কেউ
স্মৃতি উপড়ে খুব দ্রুত গজিয়ে উঠছে বরফের ইমারত
পাশেই হাই রাইজ লিখে রাখছে প্রহর শেষের নীরবতা
রাত্রি স্বচ্ছ হচ্ছে আরও.......স্বচ্ছন্দ হচ্ছে ক্রমে
:
ঘটনাক্রম :
হঠাৎ ভোরের কাছাকাছি পাখি'রা গেলে খবর নিয়ে আসে....
এ শহরে প্রচন্ড গ্রীষ্ম এখন
:
চাদরের ভাঁজে ততক্ষণে নিথর হয়ে এসেছে কোকিলের দেহ
কাল রাতে নিঃশব্দে ঝড় এসেছিল....

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...