রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে


উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব্যস্ত । বাতাসে এখন হাল্কা হিমেল স্পর্শ , সাথে মনটাও খানিক উড়ুউড়ু ... কার্তিকের মিঠে রোদ গায়ে মেখে ।

মন এখন দ্বিধাহীন
আঙ্গুলের চাপে ফেলে আসা দুপুর ভাঙা আলো
এখন কমলা সূর্যাস্তের সাথে মিঠে আলাপে মগ্ন

এরই মধ্যে পায়ে পায়ে রোদ্দুর পেরিয়ে এলো গোটা দুটি বছর । ২৬ শে মার্চ ২০১৫ য় হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে যে ব্যতিক্রমী গ্রুপের জন্ম হয়েছিল , আজ তার বয়স দু বছর আট মাস । রোদ্দুরের পথচলায় যারা সঙ্গে ছিলেন , আছেন এবং থাকবেন , সকল কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই । আগামী বছর রোদ্দুর পা রাখছে আরও বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে , ডানা মেলছে সাহিত্যের নতুন দিশায় । আশা রাখছি রোদ্দুরের এই নব কর্মক্ষেত্রে একই ভাবে পাশে পাবো আপনাদের ।

ভাল থাকুন সকলে । লেখায় থাকুন ।

শুভেচ্ছান্তে
পিয়ালী বসু


বিবর্তন - বেদব্রত বসু

লিখেছেন এক কবি, 'জল্পনা' থেকে 'জাল্পনিক',
ইনাম দেবো ভাবছি তাঁকে, গোটাকয়েক মালপো নিক,
ভাষার এই বিবর্তনে
হল্লা বন্ধ করতো! নে,
হাবিজাবি এই লেখার, 'সব চরিত্র কাল্পনিক' ! 

শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭

একলা বেশ - মন্দিরা মিশ্র

যতই ভাবি , একলা আছি- এইতো বেশ
কোথায় যেন খটকা লাগে_ একটা রেশ
তোমার কথা সদাই যেন কানে-বাজে
চাইনা যতই সরিয়ে দিতে , তোমার স্মৃতি

সময় সবার কাছেই বড় জরুরী
সময়ই পারে ভুলিয়ে দিতে সবকিছু ,
সরিয়ে দেয় সব যাতনা সব-ক্লেশ
তাইতো ভাবি একলা আছি , এইতো বেশ

"এই একলা ঘরে আমার দেশ
আমার একলা থাকার অভ্যেস
ভাবি , কিছুতেই ভাববোনা তোমার কথা
বোবা টেলিফোনের পাশে বসে " 

হঠাৎ যদি ফোনটা এখন শব্দ করে
বেজে ওঠে ঝনঝনিয়ে বিরাট জোরে
তোমার গলা ভাসে যদি আমার কানে
এসব আবার ভাবছি কেন , এইতো আছি একলা বেশ

সান্ত্বনা - সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

জোড়হাত করে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে অখিলেশ জানা রোজকার মতো বিড়বিড় করে বলতে থাকেন –”ওঁ জবাকুসুম......।” ভোরে ছাদে উঠে সূর্য প্রণাম সেরে প্রাত্যহিক কাজ শুরু করেন তিনি । এই নিয়ে রোজ ঝামেলা হয় স্ত্রীর সঙ্গে । আজও তার ব্যতিক্রম হয় না । 

অখিলেশ জানাকে নেমে আসতে দেখেই কণিকা খড়খড়ে গলায় উগড়ে দেন রোজকার বলা সেই একই কথা – “সূর্যপ্রণাম সেরে এতক্ষণে বাবুর আগমন ঘটলো ? এতো সূর্যপ্রণামের ঘটা কেন বাপু ? তোমার অতি ভক্তি দেখে সূর্যের তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ । তা নয় বাবু এখন আকাশে উঠে দিনভর ছড়ি ঘোরাতে থাকবেন সকলের মাথার ওপর ।” 

“আহঃ কণিকা । রোজ রোজ এককথা......” 

অখিলেশ জানার মৃদু প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা মাঝপথে বিফলে গেল । তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কণিকা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন – “লোকে বলে সূর্যপ্রণাম করলে নাকি উৎকৃষ্ট.....”

“আহঃ ,তুমি থামবে ?” অখিলেশ জানা বিরক্ত হন ।

“কি ভেবেছো তুমি, অ্যাঁ ? আমাকে থামিয়ে দিলেই কি সুখ্যাতির মগডালে চেপে বসবে ভেবেছো ? এই নিরপত্তাহীন জীবন কাটাতে কাটাতে আমি অতিষ্ট হয়ে পড়েছি । যতই ভাবি এবার নিশ্চয়ই ব্যবসাটার পতন রোধ করতে পারবে ঈশ্বরের কৃপায় । কিন্তু তেমন লক্ষণই যে দেখছি না । বরং এই পতন দেখতে দেখতেই একদিন মৃত মানুষে তালিকায় নাম লেখাতে হবে আমাকে ।” 

বড় দুঃখে কথাকয়টা বলে নিজের শাড়ীর ছেঁড়া আঁচলে চোখ মোছেন কণিকা । অখিলেশ জানার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে দেখে । সত্যিই তো । এতো চেষ্টা করেও ব্যবসাটাকে কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছেন না । অথচ বিমান, সুবিমল – ওরা কিন্তু দিব্যি দাঁড়িয়ে গিয়েছে এই একই ব্যবসায় । কণিকা ঠিকই বলেছে । যতই পূজোপার্বণ নিয়ে মেতে থাকি না কেন আমাকে যে এই বেহাল অবস্থাতেই আমৃত্যু থেকে যেতে হবে । 

ধীর পদক্ষেপে মূর্ত প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ক্রন্দনরত কণিকার কছে এসে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধীর গলায় বলেন – “ভাগ্যকে মেনে নাও কণিকা । এই জীবনে হলো না ঠিকই তবে পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে দেখে নিও আমাদের এই সাধনা বিফলে যায়নি ।”

দিনের শেষে - চন্দ্রিমা গুপ্ত

বেশ ব্যস্ততা ছিল সেই সময়টায়......শমিতার হাঁক ডাক, বাজার ঘাট করা, নাতিদের স্কুলবাসে তুলে দেওয়া, ওদের সঙ্গ দেওয়া ....এমনিভাবে কখন যে পার হয়ে যেত সময়! ছেলে ছেলের বউ যদিও বাড়িতে খুব কম সময় থাকত চাকরি ও আরো বিভিন্ন কারণে, তবে যেটুকু সময় থাকত জমিয়ে রাখত...একবার সিদ্ধেশ্বরবাবুকে জিন্সের প্যান্ট আর টি সার্ট পড়িয়ে ছেড়েছিল বৌমা! মেয়ের মত একমাত্র বৌমার আবদার রাখতে ওই পোশাক পড়ে সত্তর পেরিয়ে যাওয়া নিজেকে কেমন জোকার মনে হয়েছিল সিদ্ধেশ্বরবাবুর,সেদিন তবু বেশ লাগছিল ভাবতে বড় বড় পকেটওলা প্লেট দেওয়া ট্রাউশার পড়া বাবুটি চাপা জিন্স আর টি সার্টে অন্য এক চেহারায়!

দিনগুলো কেমন তরতরিয়ে কেটে গেলো ....."আশিতে আসিও না" কথাটাকে তুড়ি মেরে সিদ্ধেশ্বরবাবু এখন ছিয়াশির কোঠায়,শমিত আল্জাইমার রোগে আক্রান্ত...বেঁচে মরে আছে মানুষটা...সৌমিক তার পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়:

জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সিদ্ধেশ্বরবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন মেঘেরা সত্যি কত মুক্ত, নিজের মত করে ভাসে আকাশের গায়ে! সিদ্ধেশ্বরবাবু আসটে পৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছেন সংসার জালে......একাকিত্বের যন্ত্রণা কাটাতে মুক্তিও চাইতে পারেন না! সমিতা যে তাঁর চেয়েও অসহায়...... সৌমকদের ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে, ল্যাপটপ এর ছোট্ট স্ক্রীনে ছোট হতে হতে ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে ওরা
......... 

বড় একা লাগে - দেবদত্তা ব‍্যানার্জী

তিনমহলা বিশাল ভগ্নপ্রায় জীর্ণ বাড়িটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালের সাক্ষীর মতো। বড় সিংহ দরজার একদিক নেই।দরজার উপর দুটো সিংহর একটা ভেঙ্গে পড়েছে। লোহার দরজায় হাল্কা ধাক্কায় ক‍্যাঁচ করে আওয়াজ, নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ।আগাছার জঙ্গল পার করে একাই ঢোকে অপু। ডানা ভাঙ্গা পরীটা বহুদিন একা দাঁড়িয়ে বাগানের মাঝে, অবাক হয়ে তাকায় যেন। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোরা লনে বহুবছরের আগাছার জঙ্গল। বন্ধ দরজা জোড়ে চাপ দিতেই খুলে যায়। গোধুলীর কনে দেখা আলোয় অপু খুঁজে ফেরে নিজের শৈশব , কৈশরের স্মৃতীগুলো।
এক সময় দুর্গা পূজা হতো এই রায় বাড়িতে, আত্মীয় পরিজনে গমগম করত রায় বাড়ি। কাঠামোটা রয়ে গেছে ঠাকুর দালানে। কত বছর আলো জ্বলেনি। কেউ বাতি দেয়নি।


বংশের শেষ পুরুষ আজ দীর্ঘ তিরিশ বছর পর ফিরে এসেছে শিকড়ের টানে। আজ সে বড্ড একা, ঠিক এই অট্টালিকার মতো। একা একাই আধো অন্ধকারে স্মৃতীর গলিপথে ঘুরে ফেরে সে। একসময় আলোয় আলোয় সেজে উঠত এই প্রাসাদ। আজ পূর্ণিমার আলোয় ছাদের ভেঙ্গে পড়া কার্নিশে দাঁড়িয়ে অপু নদীর দিকে তাকায়। 
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জোয়ার আসছে। ভেসে আসে কত স্মৃতী। বংশের শেষ প্রদীপকে অনেক আশা নিয়ে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছিল দাদু। বিদেশিনীর প্রেমে মজে সবাইকে ভুলে ও দেশেই ঘর বেঁঁধেছিল সে। দাদুর শত অনুরোধেও ফেরেনি একদিন। মোহ কাটতে নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ একা পেয়েছিল। সেই একাকিত্বকেই সঙ্গী করে অবশেষে প্রত‍্যাবর্তণ। ইট বের করা দেওয়াল আর বন্ধ কপাটের ফাঁকে পরে রয়েছে কিছু সম্পর্কের দীর্ঘশ্বাস, একাকিত্বের গল্প।
চোখ বন্ধ করে অপু অনুভব করতে চায় অনেক কিছু। এদের মাঝেই কাটাবে নিজের শেষ দিন গুলো। বাতাসে ভেসে আসে একটা চেনা গন্ধ, একা থাকার গন্ধ।

যাত্রা - মুনমুন মুখার্জী রায়

-আমি এবার যাবোই তোমার সাথে। আমাদের বিয়ের এক বছর হতে আর মাত্র একটি সপ্তাহ বাকি। এই এক বছরে ক’টা দিন আমরা একসাথে কাটিয়েছি জানো? 

আলমারি থেকে কাঁচা হলুদের ওপর সেলফ ওয়ার্ক করা; সবুজ রঙের জরি বর্ডারের শাড়ীটি হাতে নিয়ে জানতে চায় বৃষ্টি। স্বাভাবিকভাবেই অপর পক্ষের কোন জবাব পাওয়া গেল না। নিজেই উত্তরটা দেয় তাই, 

-মাত্র একমাস সতের দিন। 

(মুহূর্তের নীরবতা) 
-তা’বলে ভেব না আমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। আমি জানি, একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তোমার দায়িত্ব কতটা! আমাদের বিয়েটা সম্বন্ধ করে হলেও বিয়ের আগে সব জেনে শুনেই রাজী হয়েছিলাম আমি। 

মিষ্টি মধুর স্মৃতি গুলো মনে হতেই বৃষ্টির ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির আভাষ... সেই হাসিতে মিশে ছিল অরিত্রের জন্য অশেষ ভালোবাসা। 
-বৌভাতের পনের দিন পর যখন তুমি জাহাজে ফিরে গেলে--- তারপর বুঝেছিলাম, আমিও ভালবাসতে শুরু করেছি; তোমাকে, তোমার সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষকে, তোমার ভালোমন্দ সবটুকুকে। 

খাটের দিকে সরে গিয়ে হাতের শাড়ী, ব্লাউজ আর ম্যাচিং জুয়েলারীগুলো একবার চেক করে নিল--- বিবাহবার্ষিকীতে পরার জন্য কিনলেও আজই পরবে বলে ঠিক করে সে। 
-ছুটিতে দু’বার এসেছ অবশ্য। কিন্তু তোমার সাহচর্য ঠিক সেভাবে কোথায় পেলাম বল? তুমি তো শুধু আমার স্বামীই নও, কারও সন্তান, কারও বন্ধু, কারও বা দাদা। সবারই আবদার আছে তোমার প্রতি। আমি সব বুঝি। তাই এবার আমি আর কিচ্ছু শুনবো না। 

খাটের ওপর রাখা অরিত্রের ছবিটাকে বুকের মাঝে কিছুক্ষণ চেপে রেখে বলে, 
-ভালবাসি আমি তোমায়, তুমি ছাড়া এসব কিছু অর্থহীন; একাকীত্বের অন্ধকারে নিমজ্জিত। 

ছবিটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে সাজগোজ শুরু করে বৃষ্টি।

পরদিন দুটি শবদেহের সৎকার হয়... একটি অরিত্রের; যে দুদিন আগে ডিউটি চলাকালীন উড়িষ্যা উপকূলের কাছাকাছি সমুদ্রে ওঠা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাহাজ থেকে রহস্যজনকভাবে সমুদ্রে পড়ে প্রাণ হারায়। অন্যটি ওর স্ত্রী বৃষ্টির; যে স্বেচ্ছায় ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

প্রয়াণ - বিলকিস বি পলি

সুখটা ঘুমিয়ে পড়ে 
অসুখের কোলে
শিরায় শিরায় বয়ে চলা
উত্তপ্ত লাভা
স্তিমিত হয়ে পড়ে হঠাৎ
ধুকপুক করা হৃদস্পন্দন
থেমে যায় মুহূর্তেই
একটি অবুঝ শিশু
ক্যান্সার নামক ব্যাধি
জীবনের পরিসমাপ্তি অবেলায়

ফিরে এসো - জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী

যেখানে মেঘের পরে আকাশের বাড়ি
অচেনা হাতের সাথে চোখের কোলাজ 
সে যুবক ফিরে যাক ...নক্ষত্র ঝরেছে আবেশে
সুরঞ্জনা ...ঘাসের বুকে ফিরে এসো আজ 

ফিরে এসো ফুল হয়ে ঢেউ আর পাখির মিছিলে 
হৃদয় পেতেছে মাঠ ...আকাশের চিঠি হয়ে এসো
ও যুবক কতটুকু চিনেছে তোমায় দূর থেকে
দেরি হোক তবুও যেন আমাকেই শুধু ভালোবেসো 

কথা বলো হাসো আর মন থেকে মন উড়ে চলে 
আমারও হাজার কথা জমে থাকে শিশিরের গায়ে -
মাটি হয়ে শুয়ে আছো কোথাও বুকের কাছাকাছি
তার প্রেম ঘাস হয়ে চুমে গেছে ওই দুটি পায়ে

সুরঞ্জনা ...
হৃদয়ের রঙ যেন একাকার সবুজে ও ঘাসে
তোমার দিব্যি করে বাতাসও ছুঁয়েছি ভালোবেসে
আকাশ পেরিয়ে আজ আকাশের আরো কাছে এসে

হ্যালোজেন শুদ্ধতা - রাহুল গাঙ্গুলী

ভিসুভিয়াস : অবদমিত চলার লক্ষ্যে
প্লীজ।গোটা শরীরের ক্লিভেজ্
আদপে শরীরগুলো : ভিতু ফোটনপিন্ড 
দিব্যি : আমাদের পূর্বপুরুষ।উত্তরপুরুষ
হেতলার বনবাস : গরম জওয়ানি
এই ব্যাসার্ধে : বুলেট থমকায়
ট্রিগারের আলতা চাপ
জারভর্তি জারণ শূন্যতা জারি

ওফঃ।টানটান শিড়দাড়া।খাড়াই স্নায়ু
হিটার ইঙ্গিত : আত্মঘাতী ভগ্নাংশ

আর্তি - সঞ্জয় সিনহা

নিরন্তর আমার আকাশ মেঘ করে আছে
তুমি স্নিগ্ধতা আমার মেঘলা বিকেল,
কোথায় যাবে তুমি আমায় ছেড়ে!

আবেশ লিপ্ত তুমি স্পর্শ তোমার রাঙ্গা উদ্ভাসে,
নিবিড় না হোক স্পৃষ্টতায় উত্তাল শ্বাস, 
দোলাচল ধমনী বেয়ে আকাশ বুঝেছে!
যেও না গো তুমি দূরের আকাশ
অদেখার ভীড়ে আমায় একলা করে!

পাপের কুহেলিকা - ডালিয়া অবস্থি

দূরন্ত গতিতে ছুটছে ট্রেন জঙ্গলের মাঝে। রাত নামতেই মাথার ওপরের লাইটগুলো নিভছে।দুলুনি ঘুমের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু ।নির্ধারিত সময়ের দুই ঘন্টা দেরিতে ট্রেন।সকলের নাক থেকে বিভিন্ন ঘরানার রাগপ্রধান সুর বাজছে।আমার পঞ্চইন্দ্রিয় সজাগ।বড় ভুল কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা করে,এটাই অনিবার্য।

একটা সম্পর্কের জাহাজ আজ দিক নির্ণয়ের ভুলে নিরেট হিমবাহের সাথে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ন।স্বামী, সংসার ফেলে ছুটছি মরিচীকার মোহে।বরফ শীতল অপরাধবোধে শকুনের মত অভিশাপ দিচ্ছি।সব কিছু আয়ত্তের বাইরে।ঈশ্বরের শরনাপন্ন আমি, উচ্চারিত হচ্ছে সকলের মঙ্গল কামনা।নিজেকে পঙ্গু বলে মেনে নিয়েছি,বাকি জীবনটা ক্র‍্যাচে ভর দিয়ে চলার।

কর্তব্য - রীনা রায়

'নির্ধারিত' সময়ের় দুঘন্টা পর 'ট্রেন' স্টেশনে ঢুকলো। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, 'জঙ্গলে'র পথে অনেকটা যেতে হবে। 
মধ্যপ্রদেশের এক প্রত্যন্তাঞ্চলে এক বিশেষ অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে আইপিএস সোমদত্তা সেন।
'প্রাথমিক'ভাবে ও জেনেছে, একটি ডাকাতদল রাতের অন্ধকারে ট্রেন থামিয়ে শুধুমাত্র ধনীদের সর্বস্ব লুঠ করে।
স্থানীয় পুলিশের এক বড়কর্তা ওর কথা শুনে ওকে ওখানে যেতে অনুরোধ করেছেন।
সাহসী সোমদত্তা খুশীমনে দায়িত্ব নিয়েছে।
ডাকাতের দলকে 'আয়ত্বে' আনতে ছক 'নির্ণয়' করে এগোতে হবে, 'ভুল' করা চলবেনা।


'মঙ্গল' ডাকাত অঞ্চলের সবার চোখে দেবতা।
ধনীদের লুঠ করে গরীবদের গ্রাসাচ্ছেদন করতো।


হতদরিদ্র মানুষগুলোকে দেখে সোমদত্তার মনটা নরম হলেও কর্তব্য আগে।'অপরাধ' করলে শাস্তি 'অনিবার্য'।
রিভলভার হাতে এগিয়ে গেল ও--

গুরুপ্রণাম - সুস্মিতা কুণ্ডু

আজ এই শহুরে লোহা ইঁটের জঙ্গলকে চিরবিদায় জানাবে হিমানীশ। জানেনা ওর এই সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল। এত লোক এত আঙ্গুল তুলেছে ওর দিকে যে নিজের ওপর বিশ্বাসটাই হারাতে বসেছে। 
বিদেশে মোটা টাকা মাইনের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা সবার চোখে অপরাধ। বন্ধুরাও বলছে এত অল্প বয়সে এত ঐশ্বর্য আয়ত্তে রাখতে না পেরে মাথাটাই গেছে হিমানীশের। 
অবিলম্বে একটা বিয়ে করে সংসার পাতার পরামর্শ দিচ্ছেন ওর অফিসের বস। এতেই নাকি ওর মঙ্গল, তবেই নাকি ও শুধরোবে।

ট্রেনের হুইসলে চিন্তাসূত্রটা ছিন্ন হল হিমানীশের। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে হ’লেও ট্রেনটা এসেছে। ঠিক যেমন অনেক দেরীতে হ’লেও হিমানীশ ফিরে যাচ্ছে সেই দূর গ্রামে, ফাদার ডিস্যুজার চার্চে, যেখানে অনাথ মৃতপ্রায় হিমানীশকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে কেউ ফেলে গেছিল। এক সপ্তাহ আগে চার্চ থেকে আসা একটা চিঠিতে লেখা ছিল ফাদার ডিস্যুজার চলে যাওয়ার কথা। একাই চালাতেন চার্চের সঙ্গের অনাথ আশ্রম এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। উনি চলে যাওয়াতে অনিবার্যরূপে বন্ধ হ’তে চলেছে হতভাগ্য শিশুগুলোর একমাত্র আশ্রয়। 

নাহ্, হিমানীশ পারবেনা তার পিতৃভূমিকে ত্যাগ করতে। ফাদার ডিস্যুজার স্থান নেওয়ার তার এই সিদ্ধান্ত সঠিক কী না তা নির্ণয় করবেন স্বয়ং ঈশ্বর। 

সামনের বাড়ি - শুভা গাঙ্গুলী

দীর্ঘ দিন ধরে সামনের বাড়ীর বাসিন্দাদের চেনেন আমাদের গল্পের প্রাইমারী চরিত্র সুহাসিনী দেবি, পুরোণো আমলের শিক্ষিতা মহিলা,কলেজে পড়াতেন আর তাঁর বান্ধবী নন্দিতা,
ওই বাড়ীতে থাকতো,অপরূপ রূপসীর বাবা উকিল ছিলেন,দু নম্বরী কাজে ওস্তাদ,একবার এক নিরপরাধ কে যাবজ্জীবন দেবার ব্যবস্থা করেন,এমনি আরও কত,
নন্দিতা প্রেমে পড়লো একজন মুসলিম ছেলের,দারুনল্গলা  তার, গানে মুগ্ধ হলো নন্দিতা,বাড়ীর,বাবা মায়ের প্রচণ্ড বাধা সহ্য করেও সে ছেলেটির সাথে পালাতে প্রস্তুত হলো,কিন্তু সফল হোলো না,কি করে জানি ওর বাবার দুশমন যা কিনা তিনি দুরুপপায়ে পয়সা অর্জন করে নিজেই তৈরী করেছিলেন,তারা খবর পেয়ে যায়,
গভীর রাতে সেই সদরের নীল দরজা খুলে মেয়েটি বার হলো, যথাসময়ে ছেলেটিও এলো,কিনতু তারপর আর তাদের কেন খবর পাওয়া গেলো না,অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছিলো,কিন্তু আজ অবধি কেউ জানে না তারা কেথায় হারিয়ে গেলো,

তারপর,কোন একটা ব্যাপারে,উকিল তার পরিবার নিয়ে গভীর রাতের আঁধারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়,
আজও সুহাসিনী দেবী গভীর রাতে যদি কখনও জেগে ওঠেন,তাহলে দেখেন,সামনের বাড়ীর ভেঙে পড়ে যাওয়া পুরোণো বাড়ীর দরজা আস্তে আস্তে সন্ত্ররপণে খুলে কেউ বেরিয়ে গেলো,

আজও তারা আছে তাহলে _________ 

দরজাটা খুলেই রাখি ভুলে - সুতপা সরকার

ইদানীং দরজা কবাট খুলেই রাখি
কারণ মনের ঘরে বেবাক জঙ:
সঙের মতো মুখোশ এঁটে রাখি
মন টা যাতে চিচিং ফাঁকে না দেয় ফাঁকি;

ডাকহরকরা আসে যায়; রোজ থাকি
একটা খামের আশায়; খোকা যে
বিদেশ গেছে অনেক দিন; ঠিক ততদিন
আমার বুড়োটে মনটাও নদীর ভাঙনে গড়াগড়ি খায়;

আশেপাশের লোকে বলে
খোকা তোমায় গেছে ভুলে; তাও কি হয়?
হাড় হিম ঠাণ্ডা বাতাস বুক টা কনকনায়;
তবু বলি গত হপ্তায় তো একটা চিঠি এলো;
তোমরা বাপু হয় কে নয় বলো;

দরজাটা খুলেই রাখি আশায়
খামটা ছিটকে পড়লেই ত্বরিত কুড়িয়ে
নেওয়া যায়; খোকা আমার একটু
ভুলো; পিঠে বাঁধি কুলো আর
কানে তুলো -দরজাটা খুলেই রাখি
ভুলে- হিম বাতাস আর বৃস্টি আসে ঠেলে

জবানী - রিক্তা চক্রবর্তী

পিয়নের হাতে আজকাল ফিরিয়ে দিই চিঠি 
একদা যা ছিল নির্জন আহবান
;
স্মৃতির পুণ্যতোয়াতে বিগত জন্মের ছাপ থাকেনা 
তাই ... বিষাদের জাহাজ অবশেষে ভিড়লো 
ভীষণ চেনা নৈঃশব্দ্যের শহরে 
;
ভেবেছিলাম শিমুলের ডানা হয়ে উড়ে যাবো একদিন
কিন্তু ... যাওয়া আর হয়নি 
;
বাতাসে বাতাসে পোয়াতি ঘ্রাণের মতো ভালোবাসা
কেবল আজও অমলিন আছে ... মৌন শরীরের বিষাদ পটে 

প্রেমের রসকলি - শ্রীলেখা মুখার্জ্জী

স্টোনচিপস্ ফেলা রাস্তাটায় কৃষ্ণমেঘের ছায়া
সাইকেল চাকায় প্রতীক্ষিত পদাবলীর সুর ...

বৃন্দাবনী হাওয়ায় কানাঘুসো ফিসফিস ;

ছাদের ঘুলঘুলি থেকে ভাসা চোখ
থমকানো কিছু মুহূর্ত ;

বেনী খোলা দুপুরে চোখাচোখি 
ঢিমে রোদ্দুরের আলসে ঘেঁসে...

রাধা রাধা নীল আকাশিয়া আখড়ায়
কথাগুলোর গায়ে পরাগের হলুদ রোমাঞ্চ ;

চিবুকের ছায়াঘন নিবিড়তা ঘিরে
অতল নৈঃশব্দের চোরাঢেউ তিলকছাপ.....

ঠোঁটের ওপর সর্বনাশা সেই তিল নজরবন্দী,
রহস্যের চৌকাঠে নিধুবনের শিহরণ ;

তখন চুপকথারা লাজুক আধফোটা খই--

অপরাজিতা - কৃষ্ণকলি খাটুয়া

খোলা আকাশের নীচে প্রাণ খুলে কাঁদার অধিকার আমার নেই , নেই মনের কথা খুলে বলার অধিকার ;
ভাটিয়ালী সুরের ছন্দে জীবনের সুখ ভোগের অধিকার ? না , বিধাতা পুরুষ সেই অধিকারও দেননি আমায় ..!
যদিও তাঁরই অসীম কৃপায় মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষাতে প্রথম স্থানটা বরাবর আমারই !
তবুও ..কোন এক নিঃসঙ্গ মধ্যরাতে অব্যক্ত যন্ত্রণা আর বুকের মধ্যে গুমরে মরা দলা পাকানো অভিমান বাষ্প বেরিয়ে আসে নীরব অশ্রুবিন্দু হয়ে ..
দু চোখ বেয়ে নাকের ডগা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তা ভিজিয়ে দেয় -সমস্ত যন্ত্রণার সাক্ষী বালিশটাকে !
বুকের মধ্যে সংগোপনে রাখা ক্ষতটা ক্রমে গভীর থেকে হয় গভীরতর ...
ডানাকাটা কবুতরের মত ছটফট করতে থাকা ক্ষত বিক্ষত হৃদয় খোঁজে মুক্তির পথ ...আর অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখতে হয় চড়া নিলামে বিকিয়ে গেছে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তির সিঁড়ি !!
জানি ,বন্ধু জানি ..
চির উদ্দামের অভিনয়ে হারা চলে না কোনও মতে ,
তাতে যে সৃষ্টির দুর্নাম , স্রষ্টার অপবাদ !
যন্ত্রণাকে অলংকার করে মেতে উঠি তাই নিজের মুক্তির পথ নিজে গড়ে নিতে ,
যে পথে মুক্তি পাবে হাজারো 'আমি ' ..
সৃষ্টি -ধ্বংসের উন্মাদনায় প্রাণ ভরে হেসে বলে উঠি - "জিতেছি , আমি জিতেছি ...আমি জয়ী !"

প্রাপ্তি - এস ঘোষ সুমনা

মনের অনেক গভীরে অনাদি নৈঃশব্দ্যের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেও কতবার নিঃশব্দ হয়েছি কে জানে!

খানখান নিজেকে ভেঙে জুড়তে চেয়েছি অভ্যাসবশত। অন্যস্বত্ত্বা অনর্গল হয়েছে টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রয়োজন মেটাতে।

তোমাকে খুঁজেছি আশেপাশে। নেই তুমি...

যে রঙ মুঠোভরে আকাশ রাঙিয়েছে সেই মুঠোতেই শূন্যতাও মুষ্টিবদ্ধ। 

বিস্ময় নেই কোনো। ভাবাবেগ, ভালোবাসা, ঘেন্না, প্রাপ্তি নীল সীমানায় একের পর এক রঙ ছড়িয়েছে...

সন্তর্পনে বেছে নিতে হবে শুধুই প্রাপ্তিটুকু। 

ভালোবাসা তুমি বেঁচে থাকো সকল হৃদয় জুড়ে। বাকিটুকু বয়ে যাক...

কলকল ধ্বনিতেও নদীরও নৈঃশব্দ্য আছে। চেন কি? সময়ের হাতে হাত রেখে কোন দৃঢ় অঙ্গীকারে সে ছোটে বটে! তবু ওকেও ক্লান্তি, বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেছে।

পারো যদি দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ো তাকে.

নতুন মন্ত্র - অমিতাভ সরকার

নগর ভরেছে বেহদ্দ কোলাহলে 
চারিপাশে বীভৎস চীৎকার। 
সভ্যতার মন্থনের হলাহলে 
গা ভাসায় নাগরিক সমাজ। 
:
আমার কানে বাঁশুরিয়া বাঁশি 
ধানের ক্ষেতে বাতাস বাঁধে সুর 
শাল-মহুলের ফিস্ ফিসানি স্বরে 
ভোরের হাওয়ায় সোনার রোদ্দুর।

আমি তাই পালাই বারে বারে 
উদাসী বাউল একতারার তানে
পাহাড়িয়া ঝর্ণার মিষ্টি বোলে 
দোয়েল, শ্যামা নাচে সোনার ধানে। 
:
পুটুস আর শিয়াকুলের স্বাদে 
পলাশ ফাগে রাঙ্গিয়ে নিয়ে মন 
ফিরে আসি ফিনিক্স পাখী হয়ে 
নতুন মন্ত্রে গার্হস্থ্য জীবন 

শব্দ নেই - দূর্বা মিত্র

শীতকাল | সামনের মাঠে ক্রিকেট - ফুটবল - বয়স্ক মানুষদের ছোট একটা গল্পের দল |
এক কোণে কটা স্লিপ - ঢেঁকি - দোলনা | কজন তরুণী মা - কথা বলছে বেঞ্চে বসে | ঘাসে বসা কজন আয়ামাসি - পান দোক্তায় মশগুল 
দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো শুটিং হচ্ছে | |

শ পাঁচেক মিটার দূরে এক বিশাল চার তলা বাড়ি | সাদা দেয়ালের আভিজাত্য - মেটে লাল রঙের জানলা দরজা | বাগান ভর্তি ফুলন্ত গাছ - ফোয়ারা - পাথরের মূর্তি - বেঞ্চি | সামনের পোর্টিকো তে বিদেশী গাড়ি - সাদা | 

চোখ ফেরানো যায় না সে রূপ থেকে | তবে কান পাতার দরকার নেই | এই প্রাসাদের একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছে - নৈঃশব্দ ! 
বিরাট ব্যবসায়ী ও তাঁর স্ত্রী -নিজেদের মধ্যে বা কাজের লোকেদের সাথেও কথা বলেন না আজ দশ বছর |

যমজ ছেলে মেয়ে তাঁদের - হেলেন কেলার ইনস্টিটিউট এ পড়ে |

ভাইবোন জন্মাবধি - অন্ধ - মূক - বধির | নৈঃশব্দ ও স্পর্শ - তাদের জীবনসাথী | 

বালখিল্য - হিমাংশু চৌধুরী

কাদের বাচ্চাটা ওখানে গাছের নীচে বসে কাঁদছে? লোভে চোখ চকচক করে ওঠে জুলির। ফিরছিলো নবীপুরের মেলা থেকে। আজ ওখানে কোন বেওয়ারিশ বাচ্চা ও পায় নি। এখানে এইভাবে বাচ্চা পাওয়া যাবে ও আশাও করে নি। খোদা যখন দেন, ছপ্পড় ফুঁড়েই দেন। গ্রামের দিকে পড়তি বিকেল। এমনিতেই লোকজনের আনাগোনা কম। আশেপাশে কেউ নেই দেখে সন্তর্পণে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে এদিক ওদিক দেখে কোলে তুলে নেয় জুলি। জুলির পরণে আটপৌরে শাড়ি, হাতে একটা ঝোলা, তাতে টুকিটাকি জিনিষপাতি। ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা লেবঞ্চুস বের করে বাচ্চাটার মুখে ধরিয়ে দেয় জুলি। কান্নাটা এতেই বন্ধ হয়ে যায় বাচ্চাটার।
বছর দু’ আড়াই বয়স হবে বাচ্চাটার। মেয়ে। জুলির কোলে উঠেই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে কচি কচি দুটো হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। এই বয়সের বাচ্চাই পাচার করা সহজ। নিজেরা মুখে তো কিছু বলতে পারে না। দত্তকের জালি কাগজ তৈরি করে চালান হয়ে যায় কাঁহা কাঁহা মুল্লুক। তারপরে তাদের কি হয়, জুলি জানে না, জানতে চায়ও না। ওর দায়িত্ব শুধুমাত্র বিভিন্ন মেলা, রেল স্টেশন, ইত্যাদি জায়গা থেকে বাচ্চা চুরি করে অনাথ আশ্রমটায় এনে দেওয়া।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।বাচ্চাটাকে কাঁখে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালায় জুলি। আলো কমে এসেছে। রাত বাড়ার আগে অনাথ আশ্রমটায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আর কোন ভয় নেই। চল্লিশ পঞ্চাশটা বাচ্চার মধ্যে লুকিয়ে ফেলা যাবে সহজেই। অনেক সময় এমন বাচ্চা তোলার পরে পরেই পুলিশের ঝামেলা হয়, খোঁজখবর শুরু হয়ে যায় সাথে সাথেই।
গ্রামের রাস্তা। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। আর সাথে সাথে চারপাশে অন্ধকারের একটা ঘেরাটোপ নেমে এলো। যদিও জুলির রাস্তাটা মুখস্থ, কিন্তু, অাজ কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে পুরো রাস্তাটা। বাঁকিপুরের রাস্তাটা যেখান থেকে ভাগ হয়েছে, ওখানে একটা চায়ের ছোট্ট দোকান ছিলো। জুলি একটু চিন্তায় ছিলো, দোকানি তাকে আবার দেখে না ফেলে। তাই সে মোড়টা আসার একটু আগে রাস্তা ছেড়ে পাশের মাঠের মধ্যে নেমে পড়লো। উদ্দেশ্য আর কিছুই না, দোকানের পিছন দিক থেকে সন্তর্পনে রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়ে একটু এগিয়ে ফের রাস্তায় উঠবে। কিন্তু, মোড়ের কাছে এসে সে দেখলো, কোথায় দোকান, কোথায় কি? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর ঐ পাকুড় গাছটা আবার ওখানে কোথা থেকে এলো? সে কি তাহলে রাস্তা ভুল করলো নাকি? তাই বা কি করে হয়? সোজা রাস্তা থেকে একবারও তো জুলি কোনদিকে বাঁকে নি। আবোল তাবোল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জুলি রাস্তায় উঠে এসে আবার পা চালায়।
আরো খানিকক্ষণ হাঁটার পরেও যখন অনাথ আশ্রমের বোর্ড দেখতে পেল না, তখন জুলি চিন্তায় পড়ে গেল। ওর মনে হতে লাগলো ও যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটেই চলেছে, এ হাঁটা ওর আর ফুরাবে না। কোলের বাচ্চাটাও যেন বড় চুপচাপ। সেই যে একটা লেবঞ্চুস পেয়ে চুপ করেছিলো, আর রা কাড়েনি এতক্ষণেও। ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়, জুলি ভাবে, অন্ধকারে বোঝার ও উপায় নেই।
এই তো!, ঠিক রাস্তাতেই ও এসেছে। অনাথ আশ্রমের একটু আগে একটা কবরস্থান ছিলো। বাইরে থেকে দুটো বিশাল গাছ দেখা যায়। ঐ তো আকাশের সামনে কালো দুটো গাছের ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর ঐ ছায়া দুটোর আকারও ওর বেশ পরিচিত, এতদিন ধরে এ এ রাস্তায় যাচ্ছে আসছে। এরপরেই একটা বাঁক পেরোলেই অনাথ আশ্রমের গেট। একটু তাড়াতাড়িই পা চালায় ও।
হঠাৎ তলপেটে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করায় নীচের দিকে তাকায় জুলি। আবছা আলোয় দেখে, একি, ছোট্ট বাচ্চাটার পা টা এত বড় কি করে হলো? সভয়ে জুলি দেখে বাচ্চাটার ডান পা তার চোখের সামনে সড়সড় করে বড় হয়ে জড়িয়ে ধরছে তাকে। একই সাথে বাঁ পা পিছন থেকে ঘুরে সামনে এগিয়ে আসছে। গলায় একটা চাপও অনুভব করে সে। বুঝতে পারে কচি হাত দুটোও বড় আর শক্তিশালী হচ্ছে দ্রুত। গলায় আর তলপেটে সাপের মতো জড়িয়ে ধরে তারা। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় জুলির, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বাচ্চাটা যেন অসম্ভব ভারীও হয়ে গেছে ওজনে। জুলি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাচ্চাটাকে কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করে সে বোঝে তা সম্ভব নয় আর। পা ভেঙে রাস্তার পাশে বসে পড়ে সে। "বাঁচাও, বাঁচাও" বলে চিৎকার করতে গিয়ে বুঝতে পারে, দমবন্ধ হয়ে এসেছে, গলা দিয়ে আওয়াজ আর বেরোচ্ছে না। দরদর করে ঘাম হতে থাকে। চোখদুটো মনে হচ্ছে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। বুকে একটা অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে জুলির। মনে হয় যেন বুক ফেটে যাবে। একটু হাওয়া, একটা নিঃশ্বাসের জন্য ও আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কিন্তু সেই শ্বাস আর তার নেওয়া হয় না। হাত দুটোর আলিঙ্গনপাশ আরো দৃঢ় হতে থাকে তার কন্ঠের উপর। জুলির থাইরয়েড কার্টিলেজ ভেঙ্গে হাইঅয়েড বোনের একটা অংশ শ্বাসনালীর মধ্যে ঢুকে ওটাকে বন্ধ করে দেয়। চোখ দুটো পিংপং বলের মতো ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে।
মারা যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে জুলি বাচ্চাটার গলায় খলখল করে হাসি শুনতে পায়। একইসঙ্গে পঞ্চাশটা বাচ্চা যেন হাসছে। এতদিন ধরে পাচার করে দেওয়া বাচ্চাগুলোর কথা তার আবছা মনে পড়ে, আর, এই প্রথমবার, তাদের জন্য দুঃখবোধ হয় তার।

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...