শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

LONELY SAILOR - Durba Mitra

Crowded life
Time and money flows; I remain
A lonely sailor




মানানসই - রুদ্র বোস

জানেন,
খুব আলগোছে থাকতে শিখছি এখন
এই যেমন বেশ ঘনিষ্ঠ কাউকে বলছি
-কি, চলছে কেমন, আচ্ছা আসি, ব্যস্ত খুব
কিংবা পুরোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে
- আরে, তোর চেহারাটা এমন হল কেন? সুগার নাকি?
নতুন কোনো মানুষ বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে
- হাই, কী করেন আপনি ভাই? ও আচ্ছা। কথা হবে আবার।
কাউকে একটু দেঁতো হাসি দিচ্ছি
কাউকে পিঠ চাপড়ে কাজ সারছি
কাউকে বা না চেনার ভান করে চলে যাচ্ছি
এই রকম ভাবেই চলছি এখন
অসুবিধে একটু যে হচ্ছে না তা নয়
নতুন শিখছি কি না
তবে হয়ে যাবে বুঝলেন!!
এই মাসখানেক বড় জোর
তারপর দেখবেন
ঘুঘুর ডিম থেকে শুয়োরের খোঁয়াড়
কেমন সুন্দর ফিট করে যাচ্ছি
সব জায়গাতেই।।

যাপন চিত্র - দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

শবের উপরে উড়ে যাচ্ছে মার্কিন আর ধূপধোঁয়া
শীতল পায়ের নীচ হলুদ ঢেকেছে আলতা
আলতো করে খই উড়ে চুল পেল হেলমেটহীন মাথা
ছুটছে আর দেখছে কিভাবে রোদ খেলছে জলে
আয়নায় নিজেকে ঠিক করে নিচ্ছে কয়েকটা গাছ
যদিও তাদের কোনো লাল আলো এলাকায় বেচা নেই
বেচারা আকাশ নীল সাদায় কখন স্কুল বালক
ছুটির অপেক্ষায় অসহ্য চোখ নিয়ে বসে
বসনের কথা ভুলে চানঘর খুঁটে খুঁটে নিজেকে দেখে
জল ছোঁয়ায় সাবানের লজ্জা ধুয়ে নিতে .....

অচেনা - মানস চক্রবর্তী

মেঘ ডাকলাম তবু কাজল পরলেনা
আকাশ এনে ঢুকিয়ে দিলাম ঘরে
নাপছন্দ সে পোশাক
নক্ষত্র দিলাম আঁচলে জড়াতে
ছড়িয়ে দিলে ঘরময়
অথচ ঝড় ডাকতেই মেলে দিলে শরীর
এত দিনেও চেনা হলোনা তোমায়

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

" এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে "
আকাশে বাতাসে এখন স্পষ্টতই 'পুজো পুজো গন্ধ' , ... কুমোরটুলিতে শিল্পীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে , অন্যদিকে সাহিত্য পাড়ায় চূড়ান্ত ব্যস্ততা লেখক-শিল্পী ও সম্পাদকদের , ... পুজোসংখ্যার সলতে পাকানোর সূচনা আজকাল অনেক আগে থেকেই । চার ছেলেমেয়ে সহযোগে কাশ ফুলের গন্ধ মেখে মা দুর্গা এই এলেন বলে ... 
 সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দী তে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়, এও জানা যায় দিনাজপুর এবং মালদা জেলার জমিদার সম্প্রদায়ই প্রথম এই পূজার সূত্রপাত করেন, আবার কারোর কারোর মতে নদীয়া জেলার ভবানন্দ মজুমদারের উদ্যোগেই প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয় ১৬০৬ বঙ্গাব্দে।
আমাদের বাঙালীদের প্রধান এই উৎসবের সঠিক উৎস নিয়ে নানাবিধ মতান্তর থাকলেও এটুকু আমরা সবাই জানি যে ১০৮ টি নীল পদ্ম এবং ১০৮ টি দীপ জ্বালিয়ে প্রথম এই পূজার সূচনা করেন বহুলকথিত রামচন্দ্র, দেবীর অকালবোধন এর মাধ্যমেই সম্ববত দুর্গা আমাদের জানান দিয়ে দেন যে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে ধরাধামে আবির্ভূতা হয়েছেন তিনি, আর আমরা মেরুদণ্ডহীন (ধর্মভীরু ) মানুষ তাঁকে আশ্রয় করেই বেঁচে আছি এই বিশ্বাস নিয়ে যে একদিন সব অন্যায়ের, সব অবিচারের প্রতিশোধ নেবেন তিনি।
অন্যায় আর অরাজকতার এই কালসময়ের কালো ক্যানভাসটিকে কিছুদিনের জন্য নাহয় সরিয়ে রাখা যাক , আমরা বরং মনোনিবেশ করি বৃহত্তম শারদ উৎসবটির দিকে ।

মুঠো ভরা রোদ্দুর 'এর শারদ সংখ্যায় থাকলো নানা ফ্লেভারে সাজানো একাধিক ভিন্ন স্বাদের লেখা , শারদ শুভেচ্ছা আদান প্রদানের মাঝে কিছুটা সময় নিয়ে পড়ে দেখতে পারেন লেখাগুলি । 'মুঠো ভরা রোদ্দুর 'র সমস্ত লেখক -কবি , পাঠকমণ্ডলী ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাই  শারদ শুভেচ্ছা । পুজো কাটুক আনন্দে - হর্ষে - পুলকে । 

শুভেচ্ছান্তে
পিয়ালী বসু




Show More React

এক্কা দোক্কা - বিউটি সাহা

ছোট্টবেলার ফ্রক পরা সেই
দুই বিনুনির মেয়ে
স্কুলের ড্রেসে,পিঠের ব্যাগেই
থাকতো কেমন চেয়ে।

হঠাৎ হঠাৎ বায়না জুড়তো
বিচিত্র সে সব খেলার
পুতুলগুলো করতো জড়ো
চড়কতলার মেলার।

কখন আবার চুল এলিয়ে
পড়তো শখের শাড়ি
নিজের মনে এক্কা দোক্কা
খেলতে যেত পাশের বাড়ি।

ইন্দ্রধনু প্রেম - চন্দ্রিমা গুপ্ত

অন্ধকার আকাশে নক্ষত্ররাজি 
আরও প্রজ্জ্বলিত হোক 
তোমার অনিন্দ্য সুন্দর দেহ সৌষ্ঠবে 
অপরূপ নৃত্য ভঙ্গিমায় 
অতুলনীয় মাধুর্য্যে
তুমি শুধুই আমার আবিস্কার
হে সুন্দরী,
আমি যে পুরুরবা নই, উর্বশী:
পৃথিবীর নারীর যবে
পুরুষের বাহুবন্ধনে 
লাজুক আত্মসমর্পণ 
আমরণ আসঙ্গ লোলুপতায়
সেক্ষনে, ক্ষনিকের উপস্থিতিতে 
তুমি হয়ে ওঠো আমার উর্বশী -
আমাদের ইন্দ্রধনু প্রেমের সাক্ষী হোক 
অনন্ত আকাশের 
অন্তহীন শোভা!!

আমন্ত্রণ - স্বাতী গুপ্ত

হে সুন্দরী উর্বশী
আমি নহি পুরূরবা
ইন্দ্রিয়ের ক্ষণিকের উল্লাসে
আমার অমরাবতী
:
হে অপ্সরা মরালকায়
তোমার অনিন্দ্য লাস্যে
এসো আমার ভুবনে
:
ক্ষণিকের তরে এই আমন্ত্রণ 
আমরণ আসঙ্গলিপ্সায় নয়
তোমার দেহের কদম্বের রোমাঞ্চে
নগ্নতায় দীপ্ত তনু জ্বালিয়ে যাও
এই অন্ধকার আকাশ সভায় 
:
নক্ষত্রআভায় আকাশের চলে 
রজনী শব্দহীনতায়
বাহু বন্ধে পরশ কম্পিত সলজ্জ উতসুকে
এই প্রেম ক্ষণিকের ইন্দ্রধনু সম
এসো লাস্যময়ী হৃদয়ে মম

ইনসমনিয়ার ইতিবৃত্ত ( যৌথ কবিতা ) - সুশান্ত হালদার ও জাকিয়া জেসমান যুথি

বড় বিতৃষ্ণাময় এ জীবন
দূষিত রক্তে ভরা হৃদপিণ্ড 
বড়ই অভাব ফুসফুসে অক্সিজেনের
অবাধ সঙ্গম সারাদেহে রোগ জীবাণুর
কি করে বলবো - 
এ জীবন তাঁর দেওয়া এক বড় নিয়ামক!

প্রতিরাতে হু হু করে আসে ভালুক জ্বর
প্রোটোজোয়া এ্যামিবার ফিউশনে দেহ তছনছ
অর্ধমৃত এখন প্রতিটি সেল ইনসমনিয়ায়.....
কি করে বলবো - 
সত্যিই কী ভয়ানক এ জীবন আমার!

চেয়েছিলাম ভালোবাসা বৃক্ষের 
কিন্তু তারও আজ ভীষণ শ্বাসকষ্ট
রেসপিরেটরি সিস্টেম ভাইরাসের দখলে
খোলা চোখ মেলে মোর কাটে প্রতিটি দুর্বিষহ রাত
কাতর চোখে সেও চেয়ে থাকে অদৃশ্যলোকে
তবে কি বলবো -
জীবন যাবে ক্ষয়ে ইনসমনিয়ায়?

হেরো সিরিজ ( হেরো ২৫, ২৬ ) - শুভাশিস সিংহ

হেরো -২৫
-------------
চেতনা গলিয়ে ঢেলেছি 
তোমার ছাঁচে 
সুবিধার খাটে বিন্যস্ত হয়েছি 
যথেচ্ছাচারে
অর্ধ নগ্নে মন ভরেনি


বিবস্ত্র হচ্ছি 
সুবিধার স্রোতে গতি আনতে
সবটুকু দিচ্ছি তোমাকে
সব সমর্পণের অঙ্গীকারে

কিন্তু বলতো
তোমার অওকাদ কী আছে
শুকনো বেলার নরম রোদে 
প্রথম ভুলের পাপ শোধন তোর গালে
হিয়ার দেশে অহংকারী খেলায়
লাজুক চাঁদ ঘোমটা মাথায়
এর পরে বাতাসের ফিসফিসানি
ওর অওকাদ কী বলতো
কান টানলে মাথা আসত
আঙুল বাড়ালে হাত
দিন বাড়লে আগলে রাখত
চোখের পাতার রাত
তার পরেও শুনতে হল 
তোমাদের অওকাদ কী আছে
আজ বাংলা, কাল বিদেশি
মর্গ মানে - মৃত্যু-বাসি
আগুন যখন দলিত ফুলকি
এভাবেই দিন কেটে যাবে কী
এই শালা
তোদের অওকাদ কী বে ... 


হেরো -২৬
-------------
একটা ঘুম চুরি করে দুপুর পালালে রাতের উপসর্গের হদিস মেলে
কিছু শব্দ পরিচিতি না চাইলে উল্টো দুনিয়া এগিয়ে এসে জানলায় বসে
যাঁরা এগিয়ে যায়, ফিরে তাকায় না হামেশাই তোমরা বলো - এগিয়ে চলা জীবন থেমে যাওয়াটা মরণ আর যাঁরা প্লাটফর্ম ছেড়ে লাইনের দিকে গেছে ...

শারদ প্রাতে - শমিতা চক্রবর্তী

অভিমান ভুলে আকাশ টা আজ
রোদ ছিটিয়ে হাসছে
রাতের অবিন্যস্ত বিছানায় না প্রেমের
গ্লানি চিন্হ মুছে আড়মোড়া ভাঙে
আমার সকাল --
দু -একটা আলটপকা ঝরে পড়া
শিউলির গন্ধমিশলে
চেনা ডিওডোরেন্টের গন্ধটাকেও
হঠাত্ ভালো লাগতে শুরু করে --
বেমানান জীবনটাকে কেমন
মানিয়ে নেবার ইচ্ছে জাগে --
নিস্তরঙ্গ ইছামতী মনে আজ মৃদু আলোড়ন
অভিমানহীন অনুরাগে --
কার্নিশ বেয়ে চুয়ে পড়া নরম রোদ্দুর
যে জানান দিল ----
সে মুহূর্তগুলো আগলে রেখেছে
এক আদুরে আবেগে 

তুমি এবং কবিতা - শুভ চক্রবর্ত্তী

চেনা বৃত্তের মেয়াদ মুছে ফেলে মুখোমুখি 
সরল রেখায় আমরা
জানু মুড়ে বসেছি তোমার সম্মুখে
করতলে রক্তিম আহ্বান
শুধু কবিতার জন‍্য - তুমি আমার

একাকী হিম কোনো সন্ধ‍্যায়, 
দোমড়ানো জীবনের অবশেষটুকু জ্বালিয়েছি তোমার অপেক্ষায়,
শুধু কবিতার উদগ্র নেশায় ছুয়েঁছি নীলচে মেঘ
ঝর্ণার প্রবাহ
অথবা গোধূলী আভা
কেবল তোমায় ছাড়া...

অমরত্বের দাবীদার কোনো দিনই ছিলাম না,
তাই ঘৃণার বশে বারবার ভালোবেসে ফেলি তোমায়
-জৈবিক অভ‍্যাসে...

শুধু কবিতার জন‍্য 
সব কিছু ভুলে গিয়ে তোমার হয়ে যাই
শুধু কবিতার জন‍্য 
জীবন থমকে থাকে মধ্যরাতের গানে
শুধু কবিতার জন‍্য
আমাদের জাগতিক দূরত্বকে মিলিয়ে দিই কল্পনায়

শুধু কবিতার জন‍্য
শুধু তোমার জন‍্যে...

শুধু তোমার জন্য - পারমিতা চক্রবর্ত্তী

শুধু কবিতার জন্য পৃথিবীতে আসা 
হিম সন্ধ্যেবেলায় বিস্তীর্ণ পথে শুধু 
তোমার উষ্ণতা পাবো বলে হেঁটে চলা 

অপলক মুখশ্রীর শান্ত মুখ 
সৃষ্ট শুধু তোমারই জন্য কবিতা 
তুমি শুধু নও অপরূপা 

বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ ,মেঘে গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে মৌসিনরামের বৃষ্টিপাতের শব্দে পেয়েছি তোমায় সর্বময়ী রূপে 

জ্বালাময় পৃথিবীতে বেঁচে থাকা 
শুধু তোমার জন্য 
জীবনের শত বসন্ত 
তাচ্ছিল্য করেছি 

আমার প্রতিটি স্পন্দন জুড়ে 
শুধু তুমি .....

শুধু কবিতার জন্য - অরিজিৎ বাগচী

প্রেমের কনো গ্রাফিক্স কার্ড হয় না
সে জলের মতোই স্বচ্ছ স্বাভাবিকতায়
তাই কখন সে মাথার ডাস্টবিনে
কিম্বা অ্যালকোহলিক গ্লানির গ্লাসে
জমে যায় শব্দের মাইগ্রেন হয়ে
মন ছুটি পেতে চায়
জীবন প্রাসঙ্গিকতার ভুবন পেরিয়ে
অক্ষর সমষ্টির সঙ্গা রচনা করে
শুধু কবিতার নিমিত্তেই আমার যন্ত্রণারা
শাপে বর পায়
কবিতা আবার জন্ম নেয় । 
নিঃশ্বাস নেয় প্রাণ 


শুধু প্রানের কারনেই লম্পট আমি
অবৈধ আঁচল টেনে ধরি কবিতার স্বার্থে
তোমাকে নারী মেনেই কবিতা লিখেছি কতবার
কখন রক্ত পাতের দূরত্ব বজায় রেখে
কখন একাকীত্ব সঙ্গমের লিউমেরিক
ছন্দ তৈরি করেছে নীরন্ধ্র পেন্সিল
শুধু কবিতার জন্য এই শরীরের জন্ম সত্য হয়
তবে আরেকটু বেশি বাঁচতে চাই লোভে 
পুকুরের পাশের কাদায় ঝোপ ঝাড় মাড়িয়ে
দেখতে চাই আমার পায়ের ছাপ 
মানুষের লাল চোখের হিড়িক এড়িয়ে 
লাল ফ্ল্যাগের হুল্লোড় করতে চাই 
কলমের খসখসে টানে । 
বুকের কলজে তে জল জমিয়ে রেখেছি 
ব্যাথা নেশা অক্ষর আবার গুলে গিয়ে তাতে
আমায় বারবার অন্তঃসত্তা করবে । 
কবিতা আসবে 
তাই শুধু কবিতার জন্য
 আমি একশো বার তাচ্ছিল্য করেছি অমরত্ব ।

চিঠি - দীপঙ্কর বেরা

একতলার এককামরা ঘরটায় জানলা খোলাই থাকে। সিফটিং ডিউটি শেষ করে চাবি খুলেই পায়ে লাগল খামটা। হাতে তুলেই প্রণামের মত মাথায় ঠেকিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল সাইনি। জানলা দিয়ে পোষ্টম্যানরা কেন এ রকম ছোঁড়ে কে জানে? তবুও তো দিয়ে গেল। 
সম্বোধন পড়েই মনের মধ্যে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল। এত জন সামলানোর চাপ হাওয়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা চোখ বুলিয়ে নিল। ভাল সংবাদের সাথে উপমা আর সম্বোধন আরো সুন্দর। দ্রুত হাতে স্নান সেরে খেতে খেতে আবার চোখ বোলায়। সেই সকালের রান্না ঠাণ্ডা ভাত তরকারী যেন মধুর। আয়েস করে চিবিয়ে খায়। 
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের মুখে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কাজের মাসি দেখতে পেয়েই বুঝে যায় আজ এসেছে। পিকলুর নীল অক্ষরে এত যাদু। মনে যেন একরাশ সাদা মেঘ ছড়িয়ে দেয়। এই বাসা ওই বাসা বৌদি দিদি টুকু সবাইকে ডেকে আসর বসায়। আর হাসির ছররা ছড়িয়ে নিজেকে মেলে ধরে। 
কাজের মাসিকে আদর করে ডাকে – মালতী এটা দে। মালতী ওটা দে। 
চার পাঁচ দিন আগে গেল পিকলু। এর মধ্যে এসে গেল। যাক গে, ভাল দিনগুলো সবাই কাটাতে চায়। মুখঝাড়া দিতে ভাল লাগে না। বেরিয়ে আসে। কর্মসূত্র এসব বোঝে না। পড়ার নেশায় প্রেম পাল্টি। বিয়ে করে আর ছাড়া নেই। 
এই একমাত্র ভরসা। আরও কিছু আরও কিছু কথায় কথা চাই। দু তিন বছরের মধ্যে যে করেই হোক ফিরে পিকলুর কাছে হতেই হবে। ততদিন ----
এ সব শুনে এমন হাসি হাসল সতন, সাইনি আর নিজেকে মেলে ধরার সাহস পেল না। এখনকার ছেলেমেয়েরা এমনই। পিকলুও ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সব চিঠির ব্যক্ত আজ যেন অনেকটাই অব্যক্ত। শুধুই স্মৃতি!

দুটি মাস - ইউসুফ হাবিব আহমেদ

নিকষ আঁধার পেরিয়ে
ঠিক দু'মাস পর আলোয় ঝাঁপ দেবো 
দু'মাস আমায় থাকতে দিও,
খেতে দিও,
নখ কেটে দিও ৷
একটা গোলাপ কিনে দিও,
এক গোলাপে একটা জীবন কিনে নিও 
হ্যালো সুসান ব্লেক,
ঠিক দু'মাস আমায় রাখবে না?
থাকতে দেবে না?
রাখবে না তোমার হৃদয়ের বেজমেন্টে?
হায়! সুসান ব্লেক !
তুমি জানলে না কদমফুলের স্বল্পমেয়াদী জীবনে
কতটা মুগ্ধতা দিয়ে গ্যালে!
কতটা ভালোবাসার দাঁড় তুমি টেনে গ্যালে!
দুটি মাস আমায় রেখে দিও 

অষ্টম গর্ভ - স্নেহাশিস ব্যানার্জী

(১)
যন্ত্রণা? তোমার যোনিদ্বার কই? তুমি কি অন্য কেউ?
দেখো কলসপত্রীর মুখে মুখ রাখা পাখীটির মৃত্যু পিছিয়ে গেছে
অজ্ঞান হও, কুঁকড়ে ওঠো , দাঁতে দাঁত চেপে বলো- বিবর্তন ।
যে কাঁচিটি ডারউইনের সঙ্গিনী ইদানীং নাড়িকাটায় তার অভ্যেস।
সৈন্যরা নিরাপদে নির্বাসনে , ছুটি চেয়েছে পোড়া সলতে
অস্তিত্বের কথা বলতে বলতে তোমার মুখে তুলে দিয়েছি ভাত, ভাঙা দেশলাই
ঠোঁট বেয়ে নেমে আসা ক্লান্তি মুছে দিয়েছি অন্ধকারে
এখনও ছায়াশূন্য থেমে থাকার পরে , বিস্মৃতির নাম রাত 

(২)
এক প্রবালদ্বীপের ভিতর সাজিয়ে রেখেছি রুবাঈয়াত
হিমঘর হয়ে এসো।হয়ে ওঠো ওমর খৈয়ামের আঙুল
সূতিকাগারে তোমার চিৎকারের সাক্ষী আছে যে কটি বৃক্ষ
তারা আসলে প্রতিসৃত জলকণার নগ্ন কটিদেশ, শিকড়হীন
ঘুমন্ত কৃষকটি জানে তোমায় স্বপ্নে ছুঁয়ে দেখার জন্য কাল ধর্মঘট
বৃষ্টিদিনে, ভাষাহীন কেরানীটির বুকে, জল কাদায় একমাত্র আদালত

শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

শব্দ-শবসাধনা -- পলাশকান্তি বিশ্বাস

কবিতা মানে তো শব্দ-শবসাধনা
কবিতা গোপন শ্মশানচারীর স্তব
তন্ত্রে মন্ত্রে মন্ত্রণা-যন্ত্রণা
গিলছে কবির হাড় ও মাংস, সব।
শব্দের কাছে কবি চির-নতজানু
হৃদয়, মগজ সব, সব উৎসর্গ।
লোমকূপ যত ঘাম জেনেছে জানুক
সঠিক শব্দ নরককে করে স্বর্গ।
অভ্যাস কর, অভ্যাসে হও রত,
অর্জুন তুমি, কর শরসন্ধান।
তুণীরগর্ভে শর কর সংহত,
নইলে জ্যারোপে নিজেই ছত্রখান।
তুরীয়ানন্দ পেতে চাও বুঝি কবি,
আরোহণ কর ষটচক্রের যানে
শব্দ ছন্দ চিনে নিক ভৈরবী,
সব ভুলে আজ বসে থাকো শব-ধ্যানে।

আমি ও আমার স্মৃতি - পারমিতা চক্রবর্ত্তী

স্মৃতির পাতা ভর্তি কর্কশ প্রাকারে 
অনুভূতি গুলো মুড়ে রাখা ব্যর্থতার গর্তে 

আমেরিকান ভালোবাসা 
পেতে চাইনি কখনো 
আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি বসন্তের মঞ্জিলের মত 

তবু সে মৃত নদী হয়ে রইল ....

আমার জীবন্ত রাজ্যপাঠ
মৃত হয়েই রইল 
সূর্যঘড়ির আড়াআড়ি বিশাল শকুনের নির্দয় ছায়া মাকড়শার জালে মত জড়িয়েছিল 


প্রাক্তন মুহূর্ত গুলো জীবনকে 
কালো নৌকার মত অনিদিষ্ট 
পথে ঠেলে দিয়েছে বহু কাল পূর্বে 
ঐকান্তিক মুহূর্তগুলো আজ নৈশব্দের প্রহর গুনছে 

শব্দে বাঁধা স্মৃতি - পিয়ালী বসু ঘোষ

উত্তর কোলকাতার কাছেই একটা লম্বাটানা বারান্দাওয়ালা বাড়িতে আমার কৈশোর স্মৃতি রয়ে গেছে এখনও--জাফরি কাটা সিঁড়ির জানলার ওপারে ! 
আচারের বয়ামগুলো যেখানে বেলাশেষের রোদে লোলুপ চোখে আমাদের দিকেই চাইত। ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যায় ছাদের ঘরের ছোট্ট খুপড়িতে নারকোল পাতাগুলো নুয়ে পড়ত সোহাগে। আমরা তখনো ন্যাড়া ছাদের নিচটায় লুকোচুরি খেলছি। টুন'দি, বয়ি'দি, দীপু, রিং, পিং . . . এখনও যেন শুনতে পাচ্ছি মা ডাকছে নিচ থেকে, আয় নীচে নেমে আয় বলছি---ভূতে ধরবে ! 

বুড়ি দিদিমা মারা গেছেন তখন সদ্য। ভয় পেতাম, গুটি গুটি নেমে আসতাম শব্দহীন পায়ে ! 
টুন'দি বলত, শুনছিস নূপুরের আওয়াজ হচ্ছে--বলতাম ধুর ! এদিকে সারা শরীরে তখন কাঁটা !
সে সময়ে দূরদর্শনের প্রভাবে আমরা দেখতে শিখে গেছি ভূতের ছবিতে নূপুরের শব্দ হয়, মোমবাতি হাতে বড় বড় নাচমহলের আড়ালে নায়িকারা গান গায়। মনের মধ্যে তারই প্রভাব ছিলো বোধহয়। 
তরতরিয়ে নীচে নামতেই মা চুলের মুঠি ধরে বলত, ধিঙ্গি মেয়ে পড়তে বসবি কখন ? 

স্বপ্নের মতো ভিড় করে আসছে স্মৃতিরা, শৈশব কৈশোরের বেহিসাবি উজ্জ্বল দিনগুলোর স্মৃতি, এলোমেলোভাবে---বর্ষা বিদায়ের বৃষ্টির মতো। 
আমার ছোটোবেলার সেই লম্বা টানা ছাদ আর তার দেয়ালে বরফি কাটা ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া এক অন্য আকাশ। শৈশবের লাল-নীল স্বপ্নের আর আবোল তাবোল ইচ্ছের আকাশ। ওই আকাশের হ - য - ব - র - ল'র নীচে একবার আমরা "সিন্দ্রেল্লা" করেছিলাম। আজ একলা ঘরে বন্ধ জানলার ফাঁকে দেখা স্বল্প আকাশ মনে করায় সেদিনের অবুঝ আবেদনের কথা। 

আরও কত কথা ! সেই বয়েসের কিছু পরেই ওই ছাদেই প্রেম হয়েছে পাশের বাড়ির ভিনদেশীর সাথে। তখন বরফি কাটা ছাদের ফাঁকগুলো দিয়ে সোহাগী রোদ্দুর আসত নেমে। 

এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ছাদের আড়ালে জম্পেশ ইশারা চলছে, হঠাৎ মা কখন পিছনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। বিনুনী বেঁধে স্কুলে যাবার নিয়ম ছিলো তখন। মা ওই বিনুনী ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছিলো নীচে। 
এখন হাসি অবুঝ কৈশোরের কথা মনে করে ! কিন্তু কিছু কিছু লবণবিন্দু দেখি এখনও লেগে আছে আমার অনবধানের গালে !

চোরাবালি - কস্তূরী কর

মনের চঞ্চলতা অবাধ্য হলে 
স্মরণিকা যায় চোরাবালিতে , 

বালি খুঁড়ে খুঁড়ে তোলে -
কিছু টলটলে জলবিন্দু, কিছু শব্দের মালা , গলায় জড়ায় তৎক্ষণাৎ ..........
আরো খননে সে উৎসাহী -
উঠে আসে হাস্নুহানা হাসির দু - এক লহরী, টুকরো টুকরো স্বপ্ন শল্কা ......

খননের গভীরতায় মিশে যায় সে-
বুকে তুলে নেয় জ্বলজ্বলে একটি মুখ, উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, অধরাশ্রিত হাসি -
আদরের প্রলেপ দেয় তাতে ,
নতুন ক' ফোঁটা জল সঞ্চিত করে - আবার সব ফিরে যায় বালির গর্ভে ,

ভালোবেসে চোরাবালির নাম রেখেছে সে - স্মৃতি 

স্মারক -- জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী

বাসনওয়ালা হেঁকে যায়
মা পুরানো খবরের কাগজ গুছিয়ে রাখেন
স্মৃতি বদল করে ঘরে তোলেন সৌখিন স্মারক
একেকটি কাগজ একেকটি দিনের দলিল
একেকটি পাতা
মর্গে পড়ে থাকা সময়ের লাশ

বাসনওয়ালা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে
কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত স্তন
হাসপাতালে মৃত শিশুর শরীর
সাবধানে বস্তায় ভরে রাখে
জমিহারা কৃষকের চোখ আর
স্বজনহারার দীর্ঘশ্বাস

আমি ফন্দি করে সরিয়ে রাখি
লর্ডস এর মাঠে সৌরভের জার্সি ঘোরানো
গণেশের দুধ খাওয়া আর
ডি.ডি.এল.জি র লাগাতার হাউসফুলের রহস্য
হয়তো ওইটুকুই যথেষ্ট
আমার ঘুমিয়ে থাকার জন্য
আজীবন

আমি উঠে আসি সিঁড়ি বেয়ে
ফুটফুটে চারাগাছে জল দিই
দমকা হাওয়ায় ছাদে মেলা নীল শাড়ি উড়ে গেলে
ভেসে ওঠে "লাহা বাড়ির অনিন্দিতা"র মুখ
বেজে ওঠে আলীবাবার সখের গিটার

এঁদো গলিতে নবনির্মিত স্মারক এর পাশে
এভাবেই চিলেকোঠারা বেঁচে থাকে
খবর কাগজের রক্তাক্ত স্মৃতি হয়ে

বিষাদ ও মৃত্যুর লেফাফা -- রিক্তা চক্রবর্তী



নীল বৃত্ত জুড়ে প্রবল অশনি সংকেত 
ক্ষণভঙ্গুর এ জীবনে ছায়া-অসুখ বুকে নিয়ে 
আতস কাচের মেদুর আলোয় আরও একবার চোখে পড়ে ছবিটা 
-
আদর্শ হিন্দু হোটেল , আরণ্যক , পথের পাঁচালী'র স্রস্টাকে ছুঁয়ে দেখি
জ্যোৎস্নার পেট ফুঁড়ে প্রাগৈতিহাসিক হৃদয় ভরে ওঠে শব্দের প্রসূতীঘরে 
-
আপাত শূন্য বাতাসে ফুঁ দিয়ে ভেঙে দিই যাবতীয় গল্প-উড়াল 
অনুবর্তন'এর জীবনব্যথা ভাঙে ... মৃত কুয়াশার শরীরে 
-
মৌরিফুল , তৃণাঙ্কুর'এর স্রস্টা রাত্রিকালীন লেফাফা বন্দী হয়ে ঘুমিয়ে থাকেন
সমস্ত প্রণয় আলো ঘেরা একাকী আকাশে 

পঙক্তিগুলি সার্বজনীন নয় - অর্ধেন্দু বিশ্বাস

এখন সময়ের ভিতর বেওয়ারিশ-সময় সন্ধান
আগুনের ভিতর জলের প্রতিচ্ছবি
হানাদার শব্দ এখন গভীর অন্ধকারে
তর্জনী অহংকারী অস্থি-বিশেষত্বে
মাথার উপর চক্রাকার মৃতজীবী
অন্ধকার প্রবেশ পথ যবনিকা পতনের শীতল শঙ্খ
তোমাকে স্বাগত, প্রিয় নৈঃশব্দ

তোমার হাসিতেই সুখ - জ্যোৎস্না রহমান মন

প্রথম দিনে তোমার মিষ্টি পদধ্বনি মেখে 
বিহ্বলতায় কেটেছিল একাকী সে রাত
কথার উপর কথা সাজিয়ে নিয়ে 
হেঁটেছিলে আমার স্মৃতিদগ্ধ পথে
হাতটা সেদিন হয়ত ধরো'নি
মনে তবু পেয়েছি তোমার সিক্ত ছোঁয়া।

কল্পতরু যখন ফুলফুটিয়ে গন্ধে মাতামাতি
শিকড় ছিঁড়ে উপড়ে দিলে তাকে
যোগ্যতার দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিয়ে মন
শূন্য ফলাফলে সাজালে মুগ্ধ সে'ই ক্ষণ
অপমানের আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া গল্প
অভিমানে ভিজে অপ্রকাশিত থেকে গেল। 

"তবু যদি তুমি আসতে চাও
খোলা আছে আমার দু-হাত 
জেনো এখানে নেই কোনো হিসেব
শুধু আছে নীল আকাশ 
আছে লাগাম ছেঁড়া স্বপ্ন বুকের ভেতর
আছে বেপরোয়া বোতাম বিহীন শার্ট
আছে হারিয়ে যাওয়ার নেশা নাকে মুখে
ভুলে গিয়ে রোজকার দোকান বাজার-হাট"।

আর আছে পাগল মনের ধুলো মাখা বুক
যেখানে জড়িয়ে রাখব তোমার হাসিমাখা 

বিরাম বিহীন বৃষ্টির ভেজা সুখ।

যুদ্ধটা এখনও বাকি - রীনা রায়

অনিন্দিতা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতেই দেখে, টাকুম নেই ।
পাশের ঘরে গিয়ে দেখে,বাবার ছবিটা হাতে নিয়ে মেয়ে কেঁদে চলেছে।
তবে কি আজকেও স্কুলের বন্ধুরা ওকে অপমান করেছে? 
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, 'অনেক রাত হয়েছে মা, শুবি চল। সকালে স্কুল যেতে হবে তো--'
বাধ্য মেয়ের মতো টাকুম ছবিটা রেখে উঠে এলো। মাত্র কয়েকমাসে মেয়েটা যেন কয়েকবছর বড় হয়ে গেছে ।
নীলাঞ্জন চলে গেছে আটমাস হল। তাদের তেরো বছরের বিবাহিত জীবনে শেষের দুটো বছর বোধহয় সবচেয়ে কষ্টের সময় ছিল ।এর জন্য দায়ী ঐ বিরুপাক্ষ চক্রবর্তী।
ওরা পরস্পরকে ভালবেসেছিল । একই কলেজে পড়তো যাতায়াত-ও ছিলএকই বাসে। চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি কোনোদিন । 
একদিন কলেজ যাবার সময় বাসভাড়া দিতে গিয়ে দেখে তাড়াহুড়োতে পার্সটাই আনা হয়নি। নীলাঞ্জন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে এগিয়ে এসেছিল। একই কলেজে পড়ে বলেই বোধহয় অনিন্দিতা ওর কাছ থেকে এই সাহায্যটুকু নিয়েছিল, একটাই শর্তে, টাকাটা ফেরত নিতে হবে।
আস্তে আস্তে তারা কাছে এসেছে, বুঝেছিল তারা একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। 
কিন্তু অনিন্দিতার বাবা-মা এই সম্পর্ক মানতে পারেননি। ওঁদের পছন্দের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে চান।
অনিন্দিতা তখন পালিয়ে গিয়ে নীলাঞ্জনকে বিয়ে করে। 
একটা মন্দিরে গিয়ে তারা মালাবদল করে, আঙটি বদল- ও হয় । নীলাঞ্জন বলতো, 'অঙ্গুরীয়!' মনে মনে হাসলো অনিন্দিতা। 
সেদিন রাতে নীলাঞ্জন তাকে কাছে টেনে প্রথম যখন তার অধরোষ্ঠে চুম্বন করেছিল, ও কেঁপে উঠেছিল। তার ভালবাসার মানুষের কাছে সে আত্মসমর্পণ করেছিল । প্রচন্ড পরিশ্রমী নীলাঞ্জন তার সব স্বপ্ন পূর্ণ করেছিল ।
সাধারণ চাকরী ছেড়ে ,একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল । কি প্রচন্ড নাস্তিক ছিল নীলাঞ্জন, কিন্তু সেই নীলাঞ্জন এত বেশী আস্তিক হয়ে উঠলো যে তার জন্য ওদের ছেড়ে চলে যেতেও ওর একটুও কষ্ট হলনা! অবশ্যই এর জন্য দায়ী বিরুপাক্ষ চক্রবর্তী। উনি প্রতিদিন একটু একটু করে ওর ব্রেনওয়াশ করে গেছেন । এতটাই যে, অনিন্দিতা জানতেও পারেনি, ওদের বাড়ি, ব্যবসা সবকিছু ও ঐ আশ্রমের নামে লিখে দিয়েছিল ।

তখনও ও শিষ্য হয়নি, কিন্তু বিরুপাক্ষবাবু ওকে গুরুভাই বলতেন, বলতেন, 'আর কদিন পরেই তো তুমি গুরুদেবের কাছ থেকে দীক্ষা নেবে, তাহলে, আমরা তো গুরুভাই-ই হলাম নাকি!'
মুখে মধু ঝরতো যেন, আসল নজরটা তো ছিল নীলাঞ্জনের সম্পত্তির দিকে ।
ওনার আচরণ অনিন্দিতার চোখে কখনওই ক্ষমার্হ্য ছিলনা।
এই একটা মানুষের জন্য তার সোনার সংসারটা ছারখার হয়ে গেল। আট মাস আগে তার সব স্বপ্ন ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। 
কাছেই কোনো বাড়ীতে ঢং ঢং করে ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো, রাত তিনটে। 
আজকাল রাতে আর ভাল করে ঘুমও হয়না। 
টাকুমের গায়ে হাত দিতেই ও চমকে উঠলো। মেয়েটার গা টা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । 
থার্মোমিটার দিয়ে দেখলো, বেশ জ্বর। জলপটি দিতে হবে। 
আশ্চর্য, টাকুম আজকাল ওর কোনো কষ্টের কথাই বলেনা।
নাহ্, মেয়েটার এই ক্ষয়ে যাওয়াটা ও মেনে নিতে পারছেনা।নীলাঞ্জনকে ফিরিয়ে আনার একটা শেষ চেষ্টা ওকে করতেই হবে। 
ওকে আবার একটা যুদ্ধে নামতে হবে।
এইসময় জানালা দিয়ে একটা হালকা মিঠেল হাওয়া ওকে ছুঁয়ে গেল । যেন দূর থেকে নীলাঞ্জনের পরশ নিয়ে এলো! 
ওর মনটা কেন জানিনা খুশী হয়ে উঠলো। 
ও মনে মনে বললো, নীলাঞ্জন, টাকুমের জন্য তোমাকে ফিরতে হবে। এর জন্য যা করতে হয় আমি করবো 

দুটি ছাদের মৃত্যুরহস্য - সৌভিক সেন

সতীর্থ দুটি ছাদ যেদিন প্রথম বৃষ্টি ভিজেছিল
সেদিন একটা আংটি বুনেছিলাম
বুকের মধ্যে তখন আমধুর মিশিগান…
তোর ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে আস্তিক হয়েছিলাম আমি 

তারপর থার্মোমিটারে শ্যাওলা ধরল খানিক
ছাদ পিছলে চৌচির হল আস্ত অভিমানী এক চাঁদ
জানি সময়টা ক্ষমার্হ ছিল না মোটেই

আজ বৃষ্টিটা শ্যাওলাদের দখলে
তাই ছাদ দুটো অনুষ্ঠেয় হতে পারলো না কোনদিন…

পবিত্র-অপবিত্র - সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

সৌমেন রাত্রের শেষ লোকালটায় চেপে ফিরছেন বৈকুণ্ঠপুর থেকে । গিয়েছিলেন এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে । ট্রেন থেকে নামার পর পরই স্ত্রী মানালির কথা মনে পড়লো । ইস্‌, অনেক রাত হয়ে গেল । বেচারী একলা রয়েছে বাড়িতে । মাঝবয়সে একটাই ভয় । হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতে কেউ একজন নেই যে ডাক্তার ডাকতে ছুটবে ।
শহরের বিশাল খেলার মাঠটার পাশ দিয়ে আসার সময় চাপা গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন । আওয়াজটা ভেসে আসছে অন্ধকারাচ্ছন্ন মাঠের বুক থেকে । কেউ বিপদে পড়েনি তো ! দ্রুত চলে এলেন সেই গোঙ্গানি লক্ষ্য করে । এসে ছোট্ট পকেট টর্চের আলোয় দেখলেন বছর পনেরোর একটি মেয়ে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থেকে ছটফট করছে নিদারুণ যন্ত্রণায় । দ্রুত ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে মেয়েটির মুখের সামনে ধরে বললেন - জলটুকু খেয়ে নাও মা ।
মেয়েটি ঐ অবস্থাতেই ছিটকে সরে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো – তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা ।
নিঃসন্তান সৌমেনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো । আহা রে, না জানি কি পাশবিক অত্যাচারই না হয়েছে কচি মেয়েটির ওপর । ধর্ষিতা মেয়েটিকে গুছিয়ে নেবার সময় দিয়ে গলায় সহানুভূতি মিশিয়ে বললেন - তোমার বাড়ি কোথায় মা ?
- আমি রাস্তায় থাকি এক পাতানো কাকির সাথে । মা-বাবা কেউ নেই । বোঝা গেল সামান্য হলেও মেয়েটির ভয় কেটেছে ।
- ভয় পেও না । আমি তোমার বাবার মতো । যারা তোমার ক্ষতি করেছে তাদের চেনো ?
- চিনি । বড়লোকের দুটো বখাটে ছেলে । ঘুমিয়েছিলাম । কাকীমার পাশ থেকে তুলে এনেছে আমাকে । ওইখানেই থাকে । ওদের নাম বলে দিলে আমাকে জানে খতম করে দেবে বলেছে ।
- তোমার কোনো ভয় নেই মা । থাক, ওদের নাম বলতে হবে না । এখন চলো তো আমার সাথে ।
- কোথায় ?
- আমার বাড়িতে ।
- কিন্তু আমি যে অপবিত্র হয়ে গিয়েছি বাবা ! ওরা যে আমাকে...... কথা অসমাপ্ত রেখে মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে ।
- দূর বোকা মেয়ে । নর্দমার কাদা গায়ে লাগলে কেউ কি অপবিত্র হয়ে যায় ? বাড়িতে গিয়ে ভালো করে স্নান করে নিও । দেখবে শরীরে লেগে থাকা সব নোংরা ধুয়েমুছে গিয়ে একেবারে পবিত্র হয়ে গিয়েছো ।
- তোমরা আমাকে মেনে নিতে পারবে ? তোমাদের সমাজ ?
সৌমেনের গলা বুজে এলো আবেগে - ওরে, তুই আমাকে বাবা বলে ডেকেছিস তাতেই আমি ধন্য হয়েছি । সমাজের কথা বলছিস ? যে-সমাজ মেয়েদের আব্রু রক্ষা করতে পারে না, যে-সমাজ নিগৃহীতাকে দোষারোপ করে সেই সমাজকে ধিক্কার জানাই । শোন মেয়ে, তোর এই বাবা যতদিন বেঁচে থাকবে তোকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে । এবার ওঠ । বাড়ি যেতে হবে না ? তোর মা বসে যে রয়েছেন আমাদের ফেরার পথ চেয়ে । 

ভালোবাসা ভালোবাসার জন্য - সিলভিয়া ঘোষ

ক্লোরোফিল হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে
রোদ্দুরের এখন তির্যক রশ্মি মকর সংক্রান্তির দিন গুণে চলে
পাতাটা তবুও সালোক সংশ্লেষ করে চলেছে
একটা ভালোবাসা এখনও বাঁচার আশা করে
অপেক্ষারত কান্ডটা দাঁড়িয়ে আছে মেরুদণ্ড সোজা করে
ভালোবাসার জন্য একটু রোদ্দুর দরকার পর্ণমোচীদের----

ক্ষুধার্ত - মিঠুন চক্রবর্তী

হারিয়ে যাওয়া কিছু শব্দ
খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে
একতলা থেকে দোতলা
দোতলা থেকে একতলা

শরীর, রাখালিয়া বাঁশি,
নাভিতে জমে যাওয়া ধুলো
পাশে পড়ে থাকা না ফসলি স্বরলিপি,
হাতের আঙুলের ফাঁকে গলে যায়
রঙিন জলীয় মুখ

এভাবে আর কতদিন ফিরবোনা!
অতি লৌকিক সেই ঘাম গন্ধে ভেজা
মেয়েটির অলৌকিক বাড়ি
মধ্যরাত্রে ফুটপাথে ক্ষুধা মাথাচাড়া দিলে
বিশাল অন্ধকার যোনি গহ্বরের নীচে
একটি প্রসব যন্ত্রনার জন্য দু'হাত পেতে
হাঁটুগেড়ে বসে থাকে আর্ত ঈশ্বর......

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ইপিটমি - সীমা ব্যানার্জ্জী রায়

যখন শরীরের মধ্যে বন্দী অশনি-সংকেত
মনে করিয়ে দেয় মৌরীফুলের তৃণাঙ্কুর
যখন মানুষ ফিরে আসে 
তার ব্যক্তিগত 'অনুবর্তন'-এর আদর্শ হিন্দু হোটেলে
তখন ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সুখ-দুঃখের সাথে 
আমার সুখ দুঃখ মিশিয়ে ভালোবাসাবাসি করি
'
সমস্ত দিন সমস্ত রাত নিজেকে করি ইছামতী
অলিগলি খুঁজে বেড়াই পথের পাঁচালী
ক্ষণভঙ্গুর 'আরণ্যক' নামক গূঢ় স্মৃতি নিয়ে...
সে তৎপরতা দেখার মতো , যদিও দেখা হয়নি ইপিটমি
তবুও ধূসর খাতায় লেখা আরেকটি কবিতার 
ভালোবাসা জন্ম নেয়। 

বনবাসী - অমিত রায়

অরণ্যে ও কোনোদিনই ছিলনা।
একটা আদর্শ হিন্দু হোটেল এর মতই ছিল
ওর যৌথ পরিবার।


অনুবর্তন হোয়েছে ঋতুর 
বারেবারেই মত পাল্টেছে ইছামতীও ।
যে ইছামতির সাথে রোজ গল্প হতো ওর
সে একটু একটু করে
ওর গ্রামের ভেতর আসা শুরু করতেই
অশনি সংকেত পাওয়া গেল।


গৃহবাসীর ঠিকানা
এক কংক্রিটের জঙ্গলের ফুটপাথ ।
শুরু হয়ে গেল
বেঁচে থাকার জন্য
একঘেয়ে পথের পাঁচালী ।
আর পায়ে দলা হয় না তৃণাঙ্কুর ।
মৌরী ফুল দুলে দুলে আর বলেনা
“হ্যাঁগো , চললে কোথায় ?”

ইছামতীর তীরের বনবাসী
আজ শহরের আরণ্যক।।
প্রতিদিনই নতুন স্বপ্ন
কিন্তু সবই ক্ষণভঙ্গুর ।
প্রস্তুতি আগামীকালের

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...