বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৭

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

"এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায় "
ষড়ঋতুর বর্ণিল বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলার প্রকৃতি ও মানব মন ।এর মধ্যে আষাঢ় -শ্রাবণ মাস , তথা বর্ষা আমাদের শিল্প সাহিত্যে এবং মননে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে ।
বর্ষার আবেদনের চির সুধাময় রূপটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই বেশী অনুভব করেছিলেন । সে প্রমাণ তাঁর বর্ষা পর্যায়ের গান ও কবিতাগুচ্ছ । ১৩১৭ সালে , এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আশ্রমের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি জানান- , “আজ এই ঘনবর্ষার সন্ধ্যায় প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারের ভাষা আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলতে চাইছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করবে বলে আমাদের দ্বারে এসে আঘাত করছে।'-- তাঁর এ বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট , বর্ষা ঋতুর সঙ্গে সাহিত্য , বিশেষত কবিতার কি লীলায়িত যোগ !
" এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন-ভরসা
দুলিছে পবন সনসন বনবীথিকা
গীতময় তরুলতিকা "
রবীন্দ্রনাথের হৃদয়জুড়ে বর্ষা এভাবেই শিল্প সুষমায় মণ্ডিত হয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছিল , সে প্রমাণ তাঁর 'বর্ষামঙ্গল' কাব্য । 
বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্র্য তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র, আর এই স্বাতন্ত্রবোধের জন্যই বর্ষা ' থিম হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত । মধ্যযুগীয় কবি জয়দেবের 'গীত গোবিন্দম ' বা বড়ু চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন ' এমনকি পরবর্তী কালে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয়কুমার বড়াল, প্রমথনাথ চৌধুরী ...সকলের লেখাতেই মূল থিম হিসেবে বারম্বার বর্ষা ' এসেছে ।
বর্ষা যেমন প্রেমের ঋতু , ভালবাসার ঋতু , তেমনই বর্ষা বিরহের ঋতুও । বৈষ্ণব পদাবলীর অধিকাংশ পদ আমাদের একথা বার বার মনে পড়িয়ে দেয় । মৈথিল কবি বিদ্যাপতি যখন লেখেন --
"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর "
তখন সেই বুক ফাটা আক্ষেপ , সেই দীর্ণ বক্ষ চেরা যন্ত্রণা , আমাদেরও হৃদয় ছুঁয়ে যায় ।
আষাঢ় - শ্রাবণ মানেই ভালবাসার ঋতুকাল , ... এ প্রসঙ্গে কালিদাসের মেঘদুতম -এর কথা ভোলা যায় কি ? বিরহী যক্ষ উজ্জয়িনীর প্রাসাদ শিখরে বসে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন অলকা পুরীতে তাঁর প্রিয়তমার কাছে । কালিদাসের 'মেঘদুতম' এ  বিরহী যক্ষের সেই আর্তি কি আমাদেরও হৃদয় স্পর্শ করে অমর হয়ে ওঠেনি ?
বিষাদের কবি , সুররিয়ালিজমের পূজারী জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও বর্ষা'র থিম ব্যবহৃত হয়েছে , ব্যবহৃত হয়েছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের লেখাতেও । 
বর্ষা ভালবাসার ঋতু ...বর্ষা প্রেমের ঋতু ।
মুঠো ভরা রোদ্দুর 'র এবারের সংখ্যায়  রয়েছে  একাধিক ভিন্নধর্মী  লেখা । প্রতিটি লেখাই স্ব- মহিমায় উজ্জ্বল।
বর্ষার অনুপম মাধুরীতে হৃদয় সিক্ত করে ভাল থাকুন সকলে
পিয়ালী বসু
ডাবলিন
আয়ারল্যান্ড



মনখারাপের বিকেল __কৃষ্ণকলি খাটুয়া

বিকেল ৩টা : বিছানা ছেড়ে একটা চেয়ার টেনে সুমি জানালার ধারে গিয়ে বসলো ¦ বাইরে তখনও একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়েই চলেছে ¦ যদিও বর্ষাকাল তবুও এটা নাকি নিম্নচাপের বৃষ্টি , সুমি কাল রাত্রে খবরে শুনেছে ...আগামী ৪৮ঘণ্টাতেও আবহাওয়া উন্নতির কোনও সম্ভাবনাই নেই ¦
বৃষ্টিতে ভিজতে সুমি খুব ভালোবাসে আর ভালোবাসে নিজে হাতে নৌকো বানিয়ে বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে দিতে ¦কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী হলেও তার মধ্যে এই ছেলেমানুষীটা এখনো যায়নি ¦ আজ সুমি বৃষ্টি ভেজেনি , নৌকাও ভাসায়নি .. ¦
গতমাসেই ব্রেন হেমরেজের কারণে সুমির মাথায় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ¦ এখন এই ছোট্ট ঘরটাই তার পৃথিবী ¦ জানালার ধারে বসে সুমি দেখছে কিভাবে পথের পাশে বট গাছটা, স্কুল থেকে ফেরার পথে যার ঝুরি ধরে দোল খেতে খেতে বৃষ্টি ভিজেছে একদিন ;  তাকে ছাড়াই সে আজ মনের সুখে বৃষ্টি ভিজছে ¦ একদল ছেলে  হইহই করতে বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে তারই বাড়ির পাশ দিয়ে , যে রাস্তায় একইভাবে সেও একদিন ......
"সুমি , মা আমার ...." মায়ের ডাকে সুমি ফিরে তাকালো ,তার মেঘ কালো মুখ দেখেই মা বললেন - "হ্যাঁ রে সোনা , আবার মনখারাপ করছিস ..."
"মা,আমি কি আর কোনওদিন...."
"ছিঃ ,মা ..ওকথা বলতে নেই ¦ ডক্টর বলেছেন তো, তুমি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে ¦ "
"মা , তুমি খুব ভালো ....." মায়ের আঁচলে মুখ ঢাকে সুমি ¦

মনের জানালা __ দীপঙ্কর বেরা

শ্রীতমা জানলার গ্রীলে চোখ রেখে বৃষ্টি দেখে। দুদিন ধরে ঝরতেই আছে। কখনও বাড়ে কখনও কমে। হাতে এক কাপ কফি। 
বছর পাঁচেকের মধ্যে কত কি বদলে গেল। এই বৃষ্টিতে কত ভিজত। রমা রুণু বংশীর সাথে বিল পুকুরে চলে যেত। তারপর স্কুল পেরিয়ে কলেজ। ধরে বিয়ে দিয়ে দিল গ্রাম্য সামাজিক। 
আর শ্রীতমা পরিচিত হতে লাগল শহর কালচারে। চা খেতেও জানত না। এখন বিকেলে কফি না পেলে মাথা ধরে যায়। রাতে এক দু পেগ না হলে ঘুম আসে না। হোয়াটস অ্যাপস ফেসবুক ইস্ট্রাগ্রাম না হলে সময় কাটে না। 
বাবা বলেছিল - শ্রী, মা। এত ভাল পাত্র আর পাব না। ইঞ্জিনিয়ার। 
বিয়ের পরে ঋতম বলেছিল - আমার প্রেম ছিল। তোমাকে বাধ্য হয়েছি বিয়ে করতে। 
অথচ শ্রীতমা দেখেছে ঋতমের প্রেম শুধু টাকার সঙ্গে। পাল্টানো প্রেমিকা আসে এবং কাজের বাহানায় আরও মিলিত হয় হিল্লীতে দিল্লীতে। কিন্তু কিছুতেই জানান দেয় না। কথা ঘুরায়। 
গত দুদিন আগে এসেছিল। এত ভালোবাসে যেন নিম্নচাপ বৃষ্টির মত নাদী নালা পুকুর রাস্তা ঘাট জলে জলে ভরিয়ে দেয়। শ্রীতমাও ভেসে যায়। বাধ্য হয়। তারপর নিম্নচাপ কেটে যাওয়া আকাশের মত কোন খবর থাকে না ঋতম মেঘের। যক্ষপুরীতে শ্রীতমা একা হয়ে যায় অচেনা গোলকধাঁধা শহরে। 
শ্রীতমা ডিপ্রেশনের অর্থ খোঁজে জানলার বৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

মরীচিকা __ বেথুন বেরা

শুকনো একটা মন আর উটের মতো শরীরটাকে সঙ্গী করে -
সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত আমি মরিচিকার পেছনে ছুটে যাই এই জীবনরূপী মরুভূমিতে

কখনও ক্যাকটাসের আঘাত__ কখনও মরু ঝড়ের তান্ডব__ কখনও প্রবল বুকফাটা তেষ্টা
আমাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখতে চায়

আমি জানি আমি একা__ আমি অসহায়
আমি ক্রমশ-নিঃস্ব__ দিক্ভ্রান্ত
তবুও__তবুও আমি এগিয়ে চলেছি
শুধুমাত্র 
মরীচিকাতেই হাত রাখবো বলে


কারন_ তুমি আমার কাছে শুধুমাত্র__ শুধু-মাত্র 
মরীচিকা 'ই

আসুক ফিরে সুন্দর আবার __ চন্দ্রিমা গুপ্ত

সৃষ্টির কোলাজে স্রষ্টার সুনিপুন ছোঁয়া!
লেখনীর স্পর্শে প্রাঞ্জল হোক এ মহিমা,
মননে ঐকান্তিক ইচ্ছে শুধু আমার নয় 
হয়ত সন্মিলিত আকাঙ্খা ,
বাস্তব যেন অবরুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত ভাবনায়....
সুন্দরের ক্যানভাসে ক্রমশ সুস্পষ্ট
যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি!
কল্পনার শব্দ গাঁথায় প্রচ্ছন্ন অনীহা আজ
কবি প্রতিভার!
লেখনী শব্দ সাজায় প্রতিবাদী লেখায়
নিরাশ মনে ভাবনার গোপন ভাষা স্পষ্ট হয়,
বন্দুকের নলের অজস্র বুলেটের
আঘাতে অকারণ রক্তপাত!
অশুভ বুদ্ধির শক্তি বৃদ্ধিতে বোবাকান্নার হাহাকার.....
লেখনীই হোক অজেয়,দুর্নিবার
ফিরুক ভাবনায় সৃষ্টির কোলাজ.

মৃত সঞ্জিবনী __ শুভা গাঙ্গুলী

গ্যাস্পার এক অদ্ভুত স্বপ্ন মাঝে মাঝেই দেখে, কোন এক মরুভূমি র দেশ থেকে তাকে কেই বলে, "গ্যাস্পার, এখানে একবার আমার সাথে দেখা করো,তোমাকে আমার কিছু দেবার আছে,সে এক অমুল্য বস্তু,দীর্ঘ দিন ধরে যত্ন করে আমরা রেখেছি,তোমায় খুজছি,তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হব,এতে মানব কল্যাণ হবে,এসো গ্যাস্পার"
:
কোন এক মরুভুমির দেশ সেটা, গ্যাস্পারের বয়স ২৫ বছর, astronomy তে পারদর্শী, আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান,আর রাজস্থানএর মরুভুমিতে চলাফেরার অভ্যাস আছে তার, কিন্তু কারা এরা,?
:
আবার স্বপ্ন,এবার একজন রাজার মুখ,শরীর সব দেখছে,উঠের পিঠে চলেছেন একা,কে ইনি, হঠাত ই মুখ ফেরালেন তিনি,একি একদম তারই মতো, হাসলেন, অপূর্ব দিব্যজ্যোতিতে ভরে গেলো তাঁর মুখ,বললেন এক মহান উদ্ধারর কর্তা এসেছেন,আমি চলেছি, তাঁর অভ্যর্থনায়, আমার কাছে আদেশ এসেছে,

তাঁর হাতে একটি শিশি,বললেন, এটা তে যা আছে তা আমাদের পূর্বপূরুষদের দীর্ঘ অধ্যয়নের ফসল,জগতের কল্যাণকর, আমার ভেট সেই মহামানবকে।
:
মনস্থির করছে গ্যাস্পার,সে।যাবে, রাস্তার ডিরেকসান না থাকলেও যাবে,কারণ দিক নির্ণয় করার প্রাচীন পদ্ধতি তার করতলগত,সে অনেক কিছু জানে,আকাশের তারা,চন্দ্র সূর্য সকলেই পথ দেখাতে সক্ষম, জানে সে,
:
আজ তিনদিন হয়েছে, ইজরায়েল এর মরুভুমিতে তার চলার অভ্যাস নেই, তবু দমেনি, টেলিপ্যাথি তে কথা হয় তার সাথে,সেই ব্যাক্তির,যে নাকি ওকে সেই ছোটবেলা থেকেই বলে চলেছে,তুমি সেই বংশের পুত্র যাঁরা এক অদ্ভুত জ্ঞানের অধিকারি আর ডেড সীর জল,গাছগাছড়া র তেল থেকে মহামূল্যবান ওষুধপাতি তৈরী করতেন, তাঁদের একজন এই এসেন্স দিয়েছিলেন সেই নবজাত শিশুকে,আশীর্বাদ পেয়েছিলেন তাঁরা,
:
আর একটু, সূর্য তাকে পথ দেখায়,সূর্যের তাপ তাকে স্পর্শ করে না, আর একটু, আর একটু, বৃদ্ধ বলেছেন cancer নিরাময় করার ক্ষমতা আছে এই তেলের, ২০০০ বছর ধরে এই যাযাবরেরা রেখে দিয়েছে, আর আছে একটা ছোট cradle, সেটা তারা দেবে না, তাদের good omen ওটা,
:
চলো গ্যাসপার, আর একটু,দুহাজার বছর আগে আরও কষ্ট করে যিনি দৈববাণী শুনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন, তিনিও তো গ্যাস্পার।

ফুলমতিয়া __রীনা রায়

প্রতিদিনের মতো আজও মরুভূমির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফুলমতিয়া।
ওদের গ্রামটার ঠিক পাশ দিয়েই বিস্তীর্ণ মরুভূমিটার একাংশ চলে গেছে।
ঠিক গোধূলির এই সময়টায় মরুভূমির পাশে এসে দাঁড়ানোটা কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে ফুলমতিয়ার।
ওর মনে পড়ে, লালসিং তাকে একবার বলেছিল, উঠের পিঠে চড়ে এই মরুভূমি পেরিয়ে ও মোতিয়াকে নিয়ে দূরদেশে পাড়ি দেবে।চোখের জলটা মুছে নেয় ও।
মানুষটা যে ফিরবে বলে গেছে, যতদূর চোখ যায় ও চেয়ে থাকে একবুক আশা নিয়ে---
দূর দিগন্তে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, সেদিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে ও।
কি দেখছে ? উঠের পিঠে চেপে একজন মানুষ যেন ওর গাঁয়ের দিকেই যাচ্ছে!
ও কি লাল সিং? তার একান্ত আপন পুরুষটি? ভেবেই ফুলমতিয়ার কিশোরী গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। স্বামীর স্পর্শের শিহরণ যেন ও সারা শরীরে অনুভব করলো। নিজের দুটো হাত দিয়ে মুখটা চাপা দিলো।
-----
'মোতিয়া, এ মোতিয়া--আরে এ ফুলমোতি -- কিতনা দের তক শোয়েগি রে! যা, যাকে পানি লে আ--'
ধড়মড় করে উঠে বসে লালসিংয়ের বিধবা পত্নী কিশোরী ফুলমতিয়া।
-----
ভারত-পাকিস্তানের কোনো এক অনামী যুদ্ধে ভারতীয় সেনায় কর্মরত লালসিংয়ের ছিন্নভিন্ন দেহটা কফিনবন্দী হয়ে এমনই এক গোধূলিবেলায় তার গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল ।
বাড়ির লোক বিশ্বাস করেছিল ওটাই লালসিংয়ের দেহ, শুধু ফুলমতিয়া মানতে পারেনি।
সে আজও পথ চেয়ে বসে আছে।
তার শোহর্ যে তাকে কথা দিয়েছিল সে ফিরবে! 

মুসাফির __ শ্রীলেখা মুখার্জ্জী

সাহারার দিগন্তে ,
সূর্যের পশ্চিমী রফতার তেজ হয়..

উটের ক্যারাভান থেকে দলছুট...এক বেসাহারা ,
"পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো..."

পথের ঠিকানা এইমুহূর্তে দিশাহীন
তবুও থেমে যাবার মন্ত্র জানা নেই
বালিয়াড়ীর বলিরেখা মাড়িয়ে...চরৈবেতী..চরৈবেতী

দুচোখে ওয়েসিসের ছায়াময় সবুজ সাজিয়ে
শুকনো ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি
দূরে কেঁপে ওঠে তারুণ্যের জলছবি
ছুঁয়ে নেবার অলীক স্বপ্ন--- 

আলোছায়া আঁচল লহরায়ে...

দূরত্ব ক্রমশঃ বেড়েই চলে
বিভ্রমের মরীচিকা...নিষ্ঠুর প্রহসন
তৃষ্ণার এক বিন্দু জলের দাম মাপা হয়
মরুভূমি ধুধু বুকের হাহাকারে---

এখন কেবল ইন্তেজার...এক অলৌকিক ইনায়ত্ এর

"মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ
না ঘর হ্যায় ন ঠিকানা...
মুঝে চলতে যানা হ্যায়
বাস্ চলতে হি যানা---"
'

বৃত্ত __ শঙ্খসাথি পাল

আজ নাকি পূর্ণিমা!! অথচ আকাশের চাঁদ মেঘে ঢাকা ।বাংলোর থেকে বেরিয়ে এসেছে সাঁঝ সকলের নজর এড়িয়ে, এমনকি কিংশুকও দেখে নি।নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ।জ্যোৎস্নাকে সাক্ষী রেখে বেশ কিছু বছর আগে এখানেই মিলিত হয়েছিল.. সাঁঝ আর কিংশুক ।অথচ আজকাল কী ভীষণ দমবন্ধ লাগে এই বিবাহিত জীবন ।চেনা প্রেম দাম্পত্যের মোড়কে অচেনা লাগে।
************
"বৃত্তকে তুমি কী বলবে কিংশুক? শূন্য নাকি পূর্ণ?! এই তিস্তার কোলে যে পথচলার শুরু, আজ সেই তিস্তার জলেই শেষ হোক সে পথ ।ধরে নাও, পূর্ণ হল প্রেমের পরিক্রমণ ।" - - - এমনটাই বলেছিল কিংশুককে সাঁঝ, তার শেষ চিঠিতে ।পরের দিন সকালে খরস্রোতা তিস্তার বুক থেকে সাঁঝের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহকে উদ্ধার হয়েছিল ।
**********

বৃষ্টি ভেজা রাতে পাহাড়ের বাঁকে আচমকাই যেন চোখে পড়ে সাঁঝকে.... রক্ষীদের মুহূর্তের অসাবধানতায় অ্যাম্বুলেন্সের দরজার লক খুলে ঝাঁপ মারে স্কিজোফ্রেনিক পেশেন্ট কিংশুক দস্তিদার.... 
********

বর্ষার মেঘ আজও বৃষ্টিকে কানে কানে বলে... 
"মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা /মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যকুল হলে তিস্তা... "

জীবন যখন কত্থক __ লুৎফুল হোসেন

ঘরভর্তি অচেনা আরশোলা
স্নানঘর বুকশেল্ফ কিচেন
এঁটো বাসনে মেঝেতে
পঁচনের ফাঙ্গাস ছুঁয়ে গেছে
টেবিলে চায়ের কাপে মেলে রাখা
রতিহীন বসবাস অভ্যাস উত্তাপ
প্রাইমটাইম সিরিয়াল অবিরাম
শব্দবাজ হয়ে উঠলে বাস ট্রাম
চেঁচিয়ে শহর থমকে দ্যায় অকস্মাৎ
নেভানো নিয়নের আড়ালে ছায়া
ফিশফিশ করে বলে ওঠে
দ্রুত ধরো হাত বেদনার
নতুবা জেনো তা হয়েছে বেহাত
সাথে নিয়ে যাবে সুখ এমন কি
জমানো স্মৃতির বাঁধাই ছবিটা
যেতে দেরি হলে পাখিরাও
আলসেতে বসে না বিকেলে
তবু দেখা হয়ে গেলে অকস্মাৎ
বৃষ্টির পরে ভেজা ময়দানে
শ্যাওলা ওঠা কংক্রিট বিছানো
পথে অনুক্ত খেয়ালে বৃষ্টিভেজা
আকাশের নীচে মুঠোয় মুঠোবন্দী
অতীত দৌড় দ্যায় বর্তমান
সাথে নিয়ে পায়ে পায়ে
পথে জমে থাকা বৃষ্টিজল ডিঙিয়ে
এক ছুটে সিথানের ভাঁজ লাগা
হাত ছুঁয়ে দরোজায় এঁটে যায় খিল
পথ পড়ে থাকে পথের সীমানা জুড়ে
মৃত জোনাকিরা বিড়বিড় করে -
খুচরো পয়সার গহনায় গড়েছো
অচল আলোয়ান নকশা
সব ফেলে এলে, সব, উৎসব হুল্লোড়
বাতিল ফোনের মেমোরি সেলের
পরতে পরতে জমা ছবি শখ সাধ
একাকি ছুঁয়ে দেখা নির্লজ্জ আহলাদ,
কুয়াশার মতো হেঁয়ালি যাপনে
আবিষ্কার করলে অপার সত্য;
দু:খের সাথেই শুধু জীবনের
থাকে যেনো সর্বাধিক অন্তমিল।

ফেলে আসা স্মৃতিবেলা __ মুনমুন মুখার্জী

Memory... is the diary that we all carry about with us
--Oscar Wilde
অনাদিকাল থেকে অনন্ত পথ ধরে বহমান জীবনধারা – অক্লান্তভাবে একই গতিতে সতত ধাবিত। সময়চক্রের জটিল ও যান্ত্রিক টানাপোড়েনে যাপনের উপলব্ধি, লক্ষ্য, অনুভব, গতিশীলতার পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বর্তমান মুহূর্তগুলো অতীতের গহ্বরে নিপতিত হয়। কিছু মুহূর্ত বিলীন হয়, প্রয়োজনীয়তা হারায়। আবার কিছু মুহূর্ত মনের মণিকোঠায় অবিনশ্বর হয়ে রয়। এই অবিনশ্বর টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোই স্মৃতি। যাপনের নানা বাঁকে অপেক্ষায় থাকে- পিছু ডাকে অবসরে বা কর্মব্যস্ততার মাঝে... নির্জনে অথবা সকলের মাঝে।
স্মৃতির প্রতিটি অলিন্দে লুকিয়ে থাকা টুকরো সুখগুলোই আমার যাপনের ক্লেশ দূরীভূত করে। অবসন্নতায়ও ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি যোগায়। সেই সুখ স্মৃতির অন্বেষণের মাঝে কখনও অতীত গহ্বর থেকে যদি ভেসে আসে বিষাদের কালো মেঘ, আমি তাকে এক নিমেষে উড়িয়ে দিই... পাঠিয়ে দিই দীপান্তরে। তবুও কিছু একগুঁয়ে কালো মেঘ কখনও উঁকি মারে মন আঙ্গিনায়। তেমনি এক মেঘের নাম ছিল "সিমকি সরকার।"
সিমকি আমার কলেজ জীবনের দুটি বছর আমায় জড়িয়ে ছিল ছায়ার মত- নীরবে, নিজের অস্তিত্ব তেমনভাবে জাহির না করেই। কলেজ জীবন মানে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণী। আমাদের সময় বাংলাদেশে স্কুল লেভেল ছিল দশম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপরের দুটি শ্রেণী কলেজ..... অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়। সিমকি সরকারের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত কিভাবে তা আর আজ মনে পড়ে না। এটুকুই মনে আছে-- কলেজে ওর সাথেই আমার প্রথম পরিচয়। আর প্রথম দিনটি থেকেই মেয়েটি আমার ছায়াসঙ্গী।
চার ফুট আট ইঞ্চির গোলগাল অবয়ব আর চোখে পাওয়ারফুল ভারী ফ্রেমের চশমা পরিহিতা মেয়েটি ঠিক কোন রসায়নে আমাকে নির্ভরযোগ্য বন্ধু মনে করেছিল আজও তা আমার কাছে রহস্যময়। মূলত সিমকি আর আমি চরিত্রগত দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্হান করতাম। সিমকির গাম্ভীর্য, মেপে কথা বলা, অর্থোডক্স জীবনবোধের কারণে আমি ওর বন্ধুত্বকে ঠিক সেভাবে বরণ করি নি কখনও.... ওকে উপেক্ষাও করি নি কোনদিন অবশ্য।
তখন "চাইল্ড সাইকোলজি," "এডলোসেন্স বিহেভিয়ার" এসব নিয়ে এত প্রচার ছিল না... থাকলে হয়তো সিমকিরাও হাসতে শিখতো, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে শিখতো, ভালবাসতে শিখতো নিজেকে.. অন্য সবাইকেও।
কলেজের দুটি বছর শেষ হওয়ার পথে সিমকি একদিন জানালো মেসোমশায় অর্থাৎ ওর বাবা সেদিন ইন্ডিয়া বেড়াতে যাচ্ছেন -ওর পিসি আর কাকু কলকাতায় থাকেন....তাঁদের কাছেই থাকবেন উনি। এটা ওর একটুও পছন্দ নয়। কাকতালীয়ভাবে উনি আর ফিরে যান নি সিমকিদের কাছে বাংলাদেশে, পনেরো দিন পর ফিরেছিল শুধু উনার ব্যবহার্য পোশাক, ঘড়ি আর চশমা। আর একটি চিঠি, শবদেহ পাঠানোর বিড়ম্বনা এড়াতে উনার সৎকার কলকাতায় করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হঠাৎ স্ট্রোক বলা হলেও সিমকি মানতে নারাজ। মাসিমণিকে কোন আচার মানতে দেয় নি ও। ওর স্থির বিশ্বাস ছিল উনি জীবিত।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমার আর সিমকির সাথে যোযোগাযোগ হয়নি। ও আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল.. আরও বেশি অন্যরকম .. যেটা আমাদের ঐ বয়সের সাথে সতত বেমানান। তাই হয়তো আমার দিক থেকেও যোগাযোগের কোন তাগিদ ছিলনা। জানতাম, সিমকি সিলেট মেডিকেলে পড়ে। শুনেছিলাম, ও ছুটিতে বাড়ি আসে না। এসব খবরের কোনটাই তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি কখনও। যেদিন শুনলাম, সিমকি আর নেই.... প্রচন্ড জ্বরে হস্টেলেই নিজের রুমেই সবার অজান্তেই ছেড়ে গেছে পৃথিবী .... যার প্রতি কোন মায়া ওর কস্মিনকালেও ছিল না।
জানি না কেন সেদিন চোখের জলে ভেসেছিলাম। আমি তখন বিয়ে করে কলকাতাবাসি। শুনেছিলাম, মেডিকেলে পড়ার সময় ও যে ওষুধ নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পেতো, সেটাই try করতো নিজের উপর... বড় বেশি উদাসীন ছিল নিজের প্রতি!
ততদিনে আমি কিন্তু জেনে গেছি, আত্মপ্রেমের কারণ যেমন ভালোবাসা তেমনি আত্ম-উদাসীনতা আসে ভালোবাসাহীন যাপন থেকে। সেই থেকে বিবেকের কাঠগড়ায় প্রতিনিয়ত মাথা কুটে চলেছি... সিমকি আমায় বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো, আমি যদি নিজেকে দূরে না সরিয়ে নিতাম, হয়তো এভাবে অকালে ঝরে যেতোনা মেয়েটি! সবাই জানে আমি বন্ধু বৎসল.. কেউ জানে না একটি "তথাকথিত অন্যরকম" মেয়ের বন্ধুত্বের মূল্য দিইনি অপরিণত এই আমি!
সিমকির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি প্রতি মুহূর্তে। আর্জি জানাই আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করে দিও সিমকি।

বুমেরাং __ বিলকিস বি পলি

বর্ণিল ধরনীর বিবর্ণ অবয়ব আজ
তেজস্ক্রিয়তায় বিনষ্ট তার সতেজ গর্ভ
অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের
আপোষহীন লুকোচুরি খেলায়
বাতাসে বিষাক্ত দ্যোতনার আস্ফালন
জ্যামিতিক হারে বর্ধিত মানুষের
দরকারি অক্সিজেন বর্জনে দুর্বল
সংখ্যালঘু সবুজ অরণ্য এখন
শ্বাসকষ্টে আই সি ইউতে ভর্তি
অভয়ারণ্যে শঙ্কিত প্রাণীকুল নির্বাক
বনদস্যুদের বিরামহীন অত্যাচারে
স্ফটিক জলে সংঘবদ্ধ মাছেদের
অবাধ বিচরণ আজ বিলুপ্তপ্রায়
লোকালয়ের দূষিত গার্বেজ
নির্বংশ হওয়া মাছেদের রাজসাক্ষী
এভাবে সবুজ পৃথিবী বিরান করে
তার করতলে ইটের পরে ইট সাজিয়ে
অনুপম প্রাসাদে স্বপ্ন সাজিয়ে চলে
আশরাফুল-মাখলুকাত খ্যাত নির্লজ্জ মানুষ
হঠাৎ তাই নির্মম হয়ে উঠে বৈরী প্রকৃতি
তাণ্ডবনৃত্যে উজাড় করে চলে লোকালয়
ধ্বংসের প্রতিশোধে মরিয়া হয়ে ওঠে
আপন বাসভূমি বাঁচানোর তাগিদে
আমরা যদি কেড়ে নিই
সবুজ ধরণীর প্রাণ
সেও থাকবেনা পিছু হটে
বধিবে সমান সমান
.

সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭

বিবর্তন __ এস ঘোষ সুমনা


[১]
লক্ষ্মণ রেখার ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে আকাশ দেখেছি শুধু। খাঁচায় পোষা টিয়াপাখিটা কখনও আকৃষ্ট করেনি আমায়। সবার চোখের আড়ালে উড়িয়ে দিয়েছি ওকে। সে ফিরে চায়নি একবারও।

জানলার শিকে মাথা রেখে অশ্বত্থ গাছটার সাথে রোজ কথা বলেছি আপন মনে আর জল না পেয়ে শুকাতে দেখেছি আমার টবে বট, পাকুড়ের বনসাই।

(২)
বিশ তলা ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হলে কেরিয়ার আর অর্থ দুটোই হাতের মুঠোয়। সাদা জল বড়ো স্বাদহীন লাগে আজকাল। তৃষ্ণা মেটেনা। রঙিন দামি বোতল, প্রতিদিন ঝ'রে পড়া ঘাম, রক্ত জিভের স্বাদকোরকগুলোকেই অন্য রকম করে ফেলেছে।



জানিস! আজকাল উঁচু ফ্ল্যাটের ছাদে দাঁড়ালেই ঝাঁপ মারতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে হয় 'আরণ্যক' এর যুগলপ্রসাদ হয়ে যাই!

যে নির্মাণ আমায় শূন্য, একা করে দেয়, আনন্দ কেড়ে নেয়, আত্মঘাতী হবার পথে টেনে নিয়ে যায় তাতে জীবন খুঁজে পাওয়া বড়ো দায়।

[৩]
অনেক দিনের চেষ্টায় দরজাটা খুলে ফেলেছি কিন্তু তোর মতো আমার সাজানো ফ্ল্যাট, ধনদৌলত কিচ্ছু নেই।

আমি আকাশের নীচে দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টি ভিজি। যন্ত্রণাগুলো ঠাণ্ডা হয়। আমি রোজ খেতে পাই না জানিস! শোবারও জায়গা নেই! 

লোকে আমায় কীসব বলে! আমি সব টব দুমদাম আছড়ে ভেঙে ফেলি যে! চারাগাছগুলো লাগিয়ে দিই এখান ওখান।

হুম... তুইও যুগলপ্রসাদ হয়ে যাস।


কৃষ্ণচূড়া লাগিয়েছি। অনেকদিন পর যদি কোনো বৃষ্টিবেলায় হেঁটে যাস, দেখিস ফুল ঝ'রে পড়বে তোর মাথায়।

* * *

আমি তখন থাকব না!

স্বীকৃতি __ রীনা রায়

"যাও পাখি বলো হাওয়া ছলোছলো আবছায়া জানলার কাঁচ আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে রূপকথা আনাচ কানাচ ---", প্রিয় গানটা গুনগুন করতে করতে আলমারিটা খোলে শ্রাবন্তী।
অলিভ সবুজ জামদানিটা বার করেও আবার ঢুকিয়ে দেয়।এটা সন্দীপের বড় প্রিয়় ছিল, মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। 
না, এটা আর পড়বেনা ও।
অবশেষে মভরঙের তসরটাই বেছে নেয় আজকের অনুষ্ঠানের জন্য।আজ তার জীবনের একটা স্পেশাল দিন! 
সাহিত্যের জন্য বিশেষ সম্মান ও একটা মোটা অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দিচ্ছে বাঙলা সাহিত্য অ্যাকাডেমি।
মনে পড়ে এরকমই এক অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের আসর থেকে ফিরতে রাত হওয়ায় সমুদ্র তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
সন্দীপ সেদিন চরম অশান্তি করেছিল। আস্তে আস্তে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং শেষমেশ তারা আলাদাও হয়ে যায়।
----
আজ বাঙলা চ্যানেলগুলোয় তাকে নিয়ে একটু হলেও আলোচনা হচ্ছে।
হাতে রিমোট নিয়ে অলসভাবে সার্ফিং করছিল শ্রাবন্তী।
একটা লোকাল চ্যানেলে চোখটা আটকে গেল, এ কাকে দেখছে ও! কি শুনছে! ঋদ্ধি! ওর ছেলে, ওর কবিতাপাঠ করছে, ---

"মধ্যরাত্রি
ডায়েরীর ইতস্তত ছেঁড়া পাতায় কর্তিত জিহ্বার ঘ্রাণ 
অযাচিত ক্রমব্যবহারের পর 
স্নায়ু ক্লান্ত হয় … ন্যুনতম শব্দগুলিকেও আলোচনা’ মনে হয়
তবুও অক্ষরের মৃত্যুকাল পেরিয়ে
কবিতা’র উদযাপন সম্ভবপর হয় …… স্রোতের উজানে " 

সমস্ত শরীর দিয়ে কবিতাটা শুনলো শ্রাবন্তী।চোখদুটো জলে একাকার।
উফ, এই চোখের জলগুলো এমন অসময়ে আসে--- আমার ঋদ্ধিটাকে দুচোখ ভরে দেখি ---
" কনগ্রাচুলেশনস মা! আই লাভ ইউ" ---কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল যেন।
এই ছেলেকে ওরা কেড়ে নিয়েছিল, মা ব্যভিচারী এই অপবাদে ।
শ্রাবন্তীর মনে হল, এইমাত্র ও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটা পেয়ে গেল।

ন হন্যতে __ রিক্তা চক্রবর্তী



আজ তিন মাস হল । 
' ব্লুমফিল্ড ' নার্সিং হোমের দোতলার কোণের ঘরটায় মিতুলের দুধ সাদা শরীরটা ঝরে পড়ার অভিমুখে এক একটি স্তব্ধ পদক্ষেপ নির্মাণ করছে ...
আজ সকালেই রুটিন চেকআপের পর ডাক্তার সান্যালের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা পেয়েই গেছে মিতুল । মা'ও একরকম হাল ছেড়েই দিয়েছিলেন মাস দুয়েক আগে , উপমা দেওয়া হীরের আংটি নয় মিতুল ... তাই তার পিছনে একতরফা ইনভেস্টমেন্টে লাভই বা কি ? 

মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে । জানলার পাশের অমলতাস গাছটা ( যার বৈজ্ঞানিক নাম Cassia fistula নামটা একেবারেই পছন্দ নয় মিতুলের ) তার সোনালী আভা বিচ্ছুরণের মধ্যস্থতায় এই একাকী মেঘলা বিকেলটাকেও কেমন সোনারঙে ভরিয়ে তুলেছে !

আজকাল নিঃশ্বাস নিতে গেলে খুব কষ্ট হয় মিতুলের । পাঁজর অব্দি ছড়িয়ে পড়েছে মারণ অসুখ । 
সৌরভের দেওয়া বইটা বুকর‍্যাক থেকে হাত বাড়িয়ে নেয় মিতুল ------ 

" মধ্যরাত্রি
ডায়েরীর ইতস্তত ছেঁড়া পাতায় কর্তিত জিহ্বার ঘ্রাণ
অযাচিত ক্রমব্যবহারের পর
স্নায়ু ক্লান্ত হয়… ন্যুনতম শব্দগুলিকেও আলোচনা’ মনে হয়
তবুও অক্ষরের মৃত্যুকাল পেরিয়ে
কবিতা’র উদযাপন সম্ভবপর হয়… স্রোতের উজানে " 

ব্লু এপ্রনে সাজিয়ে মিতুল কে বাইরে আনেন সিস্টার । 
নীল রঙ বড় ভালোবাসতো মেয়েটা ! আজ সকালে মিতুলের নিষ্প্রাণ শরীরটা নীল কাগজ ফুলে সাজিয়েছে সৌরভ , তখনও মিতুলের হাতে ধরা ' শেষ আলো সাম্পান ' ... তার প্রিয় কবির প্রিয় বইটি । 

রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭

ঋণী __ সুমনা দত্ত

ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছ তুমি।
তুমি না, তোমার শরীর।
মাথার পাশের দুদিকে রজনীগন্ধা ফুল.. 
ফুলদানিতে হাসছে ওরা।
হয়তো কোন গুণমুগ্ধ ছাত্র তোমার
নিয়ে এসেছে শেষ দেখার সময়।
তারপরে সেটা যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছে মালতী দি।
যূথিকারা কাঁদছে,
দেবায়ন বাবুরা তোমার আঁকা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করছে।
সেই ফুলপিসিমা আছে না?
সে আবার মাকেই দায়ী করছে তোমার এই অসময়ে চলে যাওয়ার জন্য!
তারসাথে আবার কাকামনিও যোগ দিয়েছে।
অনন্তদারা তোমার সাথে চারুলতাদিকে মিশিয়ে গল্প করছে।
বলছে, বুড়োবয়সে ভিমরতি!
মিলন দা মাঝেমাঝে এসে সবাইকে চা দিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্কিমবাবু এরই মধ্যে সিরিয়াস।
তোমার আঁকার কপিরাইট নিয়ে মেতেছে ওরা।
সুধাময়দা এসে অনেক কিছু বিল ধরিয়ে গেল
পেপার, দুধ, আয়রনের..
আমায় বলল দাম মিটিয়ে দিতে।


ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছ একা তুমি,
এক আষাঢ় আলোচনা নিয়ে!

দৃশ্যপট __ নয়নিকা সেন

আজকাল প্রায়শই গলার কাছে আটকে থাকে বাতাসের শুষ্ক বীজ
দিন যাপনের প্রাত্যহিক কাচে 
দপদপ করে বাদামী আলোয় পুঞ্জ 


সকাল গভীর হলে লক্ষ করি
শুকনো আঁশ পড়ে আছে হাওয়ার শরীরে
অথচ বিচ্ছেদ মানে তো আবেগ না লিখতে পারা ...


তাই তালুর মাঝখান পেতে রাখি আগুনে
সেইসব ফিকে না হওয়া কথাগুলিকে মেপে রাখি ন্যাপথলিনে


রংহীন ধাতব শ্বাসাঘাতে আমায় সঙ্গ দেয় সমুদ্র -ঘড়ি 
আর ভিনদেশী ' নামে পাল্টে গিয়ে
অশেষ মায়ায় জড়িয়ে থাকো তুমি ...

প্রায়শ্চিত্ত __ লীনা রায়চৌধুরী

উত্তরের হাওয়া জাঁকিয়ে বসার দিন গুনছে।বাতাসের মতই এলোমেলো মন।কানাঘুষো শুনছি,সে আসবে।কাল বাবা এক প্রত্যাশিত ফোন আসার পর ঘোষণা করে দিল-সেই আকাঙ্খিত ব্যক্তি অর্থাৎ আমার বাবার বাল্যবন্ধু সুধাংশু কাকুর মেয়ে সায়ন কাল আসবে আমাদের বাড়িতে ।একরাশ খুশির হাওয়া নিয়ে সে আসছে,এই সাদামাটা, একঘেয়ে-অনাড়ম্বর জীবনে।শুধু কালই নয়,থাকবে বেশ অনেকগুলো দিন।বি,এড এ সুযোগ পেয়েছে-জি,সি কলেজে।হস্টেল বা পি,জি কেন!আমাদের বাড়ি থাকতে! আমি পলাশ-নিজের ঘর,আলমারি, বাথরুম- হয়ত খানিকটা ব্যক্তিসত্ত্বা ও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত বা দিতে হবে।
স্টেশন থেকে তাকে আনতে যেতে হল সেই আমাকে ।জনবহুল স্টেশন চত্বরের চতুর্দিকে তাকিয়ে খুজে চলেছি- অসহায় লাগছে!সেই কোন ক্লাস সিক্সে দেখেছি! কিন্তু আমাকে সায়ন ঠিক চিনে নিল।জানিনা কোন ক্ষমতার জোরে ।দেখে চমকে উঠলাম- আপামর বাঙালি মেয়েদের থেকে অত্যধিক সাদা রঙ,বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা ।প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে ।ভগবান তাকে সব দিয়েছে- রূপ,গুণ,অশেষ অর্থ সব ঢেলে দিয়েছে।
প্রথম ধাক্কা খেলাম রিক্সায় উঠতে গিয়ে ।প্রথমত সে আমার সঙ্গে যাবেনা।যদিও আমার সঙ্গে ছিল সাইকেল ।তার অজ্ঞাত ।তারপর ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি- দশ টাকা কম -বেশি নিয়ে রিক্সাওয়ালাকে সেকি রূঢ় কণ্ঠে ধমক।বুঝলাম- যে আধুনিকতার ছাপ ওর সর্বাঙ্গে, যে রুচির আভিজাত্যের ছাপ পোশাকে- তা মজ্জার সঙ্গে মেশা নয়,বাইরের সাজের মতই আরোপিত ।যত আমি মেটানোর চেষ্টা করি-ততই সেটা গর্জনে পরিণত হয় ।রিক্সাওয়ালাও তিরিক্ষি মেজাজ দেখায়।বাড়ির ঠিকানা শুনে একটু যেন নরম হল।যত বোঝানো হয় সায়নকে এটা পৌরসভার বেঁধে দেওয়া রেট।ও কিছুতেই মানবে না ,জিভ শানিয়েই চলেছে ।
স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরচুর ।আমি মধ্যস্থতায় আসি।ইঙ্গিতে রিক্সাওয়ালাকে বুঝিয়ে দি বাকি টাকাটা আমি দেব।সেও কম যায়না।গজ গজ করতে করতে চলল।আর আমি সঙ্গে সঙ্গে চলেছি সাইকেল নিয়ে, আর ভাবছি- দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, ভীরুর উপর সাহসীর ক্রোধ, আমরা চিরকালই দেখে আসছি।
চিন্তাজাল ছিন্ন হয় ,রিক্সার কর্কশ হর্ণে।আমি নিজেই খেয়াল করিনি কখন বাড়ি এসে গেছে।যাক ঠিক ঠিক ঠিকানা বোঝাতে পেরেছি! সব সময় এটাই শুনি,আমি সবেতেই ভুল করি,আমার দ্বারা কিচ্ছু হয় না!
যথারীতি তিনি ভাড়া পনের টাকা দিলেন।আমি প্রমাদ গুনছি-দক্ষ -যজ্ঞের!আমাকে অবাক করে দিয়ে- নির্বিকারে রিক্সা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।আমি লুকিয়ে দশ টাকা দিতে উদ্যত হতেই,রিক্সাওয়ালা থমথমে মুখে আমার কাছে এসে বলল,"মাস্টার বাবুর বাড়ি বলে এসেছি, তাঁর অতিথি, তিনি কখনো আমাদের সাথে অন্যায্য ব্যবহার করেননি ।" আমি দশ টাকা দিতে যেতেই, সে উল্টে আমার হাতে সায়নের দেওয়া পনেরো টাকা ফেরত দিয়ে বলে উঠলো,"এই ন্যান,ওনারে টাকাটা দিয়ে দেবেন।যে ভুল করেছি ,তার প্রায়শ্চিত্ত করলাম ।" আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! যে দুর্বল, যে ভীরু সে তো সর্বদাই অসহায়- শঙ্কিত ।

বিপ্লবের বোম্বাচাক __ হিমাংশু চৌধুরী

লাখ লাখ মানুষজন এদিকে ওদিকে
চরে বেড়ায়; তারা ঘাসে মুখ দিয়ে
দিব্যি ভাবে রাজভোগ খাচ্ছি।

বেয়োনেট এসে যখন ছিন্নভিন্ন করে,
তারা সমস্বরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
ও কিছুনা স্যার, সুড়সুড়ি লাগছে।।

চোখে ঠুলি পড়িয়ে রাখা কলুর বলদ
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে,
আর কলু ভাবে, অনেক কাজ হচ্ছে।

আপাত শান্ত সব দৃশ্যপট, নির্বিকার
ভাবে মেপে রাখে সে। শুধুমাত্র
একটা স্ফূলিঙ্গের অপেক্ষা। 

একটা স্ফূলিঙ্গ, যা আগুন লাগিয়ে দেবে
ঐ পাখির খাঁচার মতো বুকগুলোয়। আবার
সিংহ গর্জন করে উঠবে অনায়াসে।

অথবা, রাস্তায় পড়ে থাকা লাশেরা যেদিন
জ্যান্ত হয়ে উঠে প্রান্তর থেকে তেপান্তরে
ছড়িয়ে দেবে দাবানল, চিরহরিৎ বনের মাঝে।

একটা কৃষ্ণচুড়া অথবা জারুল যেমন
শহরের রাস্তায় বসন্তের পূর্বাভাস দেয়।
অথবা একটা কালবোশেখি নতুন শুরুর।

একটা হাত যেদিন হাতুড়ির ভারে নীচু না হয়ে
মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উপরে উঠবে। অথবা
একটা মাথা নত না হয়ে সোজা তাকাবে।

সেদিন ফ্যাতাড়ুরা উড়ে যাবে আকাশে
আর বারুদের ঘ্রাণ ভাসবে বাতাসে।
আর দিকে দিকে ফুটে উঠবে ফুল।

সেদিনই বিপ্লবের সাথে কথা বলবে হার্বার্ট।
বিপ্লব আজ মৃত। তাও বারুদ গন্ধী ফুল ফোটার
ঝঞ্ঝায় বেঁচে উঠে বিপ্লবরা দীর্ঘজীবী হোক।

এলিভেটেড গিলোটীন __ রাহুল গাঙ্গুলী

ডিনামাইটে বাঁ বুকের আর্মেচার পুড়লেই
বুঝতে পারি পাকাপাকি আরেকবার হাতবদল

শাদাকালো : ক্লান্তিকর বিভেদ নেই
হাত বাড়াই।তোমার গোপন বোতাম।গোপনে

আমারও কিছু কেরানি মার্কা ঋন
হাওয়া দেয়।কাচগুলোর ঝনঝনানি

ত্রিফলা ইস্পাতের নৌকায় প্রমুখ ইস্তফা
কেউকেউ বলে : ওহে হাতকাটা মাগিখোর

বেশ তো চলেছিস মিছিলে।মিছিলে ঝান্ডা হাতে
নুনু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পিছলোচ্ছে পা

কসম্ খাচ্ছি মাইরি।নোটায় ছাপ্পা মারবো না
স্বচ্ছ ভারতের দাবি রেখে যাবো আজন্মকাল

কথার আগুন __ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়



একটা কথার ফিনকি থেকে, একটা যুদ্ধ সৃষ্টি হবে
পথপার্শ্বে আছড়ে পড়েই, মনটাকে কষে ধাক্কা দেবে

একটা ব্যথা লাগাম দিয়ে ঢুকবে গিয়ে বুকের মাঝে
অনেক স্বপ্ন ঝাঁপ দেবে উথাল পাতাল পুতুল নাচে

স্বার্থ নিয়ে শখের চাবুক বুকের মাঝে 
আদর দিয়ে থেঁৎলে দেবে মোমের ছাঁচে

কল্পনা হবে, জল্পনা হবে, বিস্ফোরণ শুরু হবে
দুর্বিনীত ভাগ্য নিয়ে বাসনা-পুতুল শুধু মরবে

কুপির আলো পাল্লা দেবে দুরন্তপনায়, খুলবে মুখোশ
জেলখানাতে বিদায় নেবে স্বচ্ছ প্রদীপ, আগ্নেয় রোষ 

বারুদ গন্ধে সারা শহর মাতাল হবে
তখন, একটা আশ মেটানো যুদ্ধ হবে

ভানু - কাদম্বরী ___ অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য

বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণের প্রেম এক শাস্ত্রীয় মর্যাদা পেয়েছে। যে প্রেম কে বাস্তবের সাথে মেলানো যায় না। অথচ বাস্তব প্রেমের সব উপাদান সেই প্রেমে আছে। পূর্বরাগ, অনুরাগ এগুলো প্রেমের এক একটা শাস্ত্রীয় পর্যায়। সব কিছুর মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের প্রেম এমন একটা শাস্ত্রীয় পর্যায় পৌঁছে গেছে যেখানে বাস্তবের সাথে অমিলটাই বেশি। কেউ বলেন রাধার সুখ অধিক কেউ বলেন রাধার অত্মসমর্পন। রাধা সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন। শাস্ত্রে যাকে বলা হয় রাগাত্মিকা অথবা রাগানুগা। সাহিত্যের দর্পনে সমাজের যে চিত্র ফুটে ওঠে সেখানে নায়ক নায়িকার মিলনের সাথে রাধা কৃষ্ণের মিলনের একটা মৌলিক পার্থক্য থেকে গেছে। বাস্তবের প্রেম লৌকিক। রাধাকৃষ্ণের প্রেম অ-লৌকিক। তাই কৃষ্ণকে বলাহয় রসরাজ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। বাংলা সাহিত্যে এরকম আর একটি সম্পর্ক আছে. রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ বা ওনার বৌঠানের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল, সেটা চর্চা করা অবান্তর। তবে সেই সম্পর্কের যে সাহিত্যিক প্রতিফলন আমরা পেয়েছি সেটা বাংলা সাহিত্যে বিরল। যা রাধা কৃষ্ণের প্রেমের সাথে সমতুল্য।
ব্যারিস্টারি পড়তে অথবা এই এ এস হতে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যান। বিদেশে পুরুষ নারীর প্রগতিশীল কালচার দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে অনেক পরিবর্তন আসে। যে পরিবর্তন ধরা পড়ে কবির লেখা তৎকালীন তেরোটি পত্রতে যেগুলো ছিন্নপত্র তে স্থান পেয়েছে। সেই সময় বিদেশী মহিলাদের সম্পর্কে কাদম্বরী দেবীর কটাক্ষের উত্তর দিতে কবি লেখেন -তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতার। পরে গানটি ব্রাম্হসংগীত হিসেবে গাওয়া হতো। অর্থাৎ প্রেম পর্যায় থেকে জন্ম নিলেও এই গানের আবেদন পূজা পর্যায় তে। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পাঁচ মাস পর কাদম্বরী দেবী জ্যোতিন্দ্রনাথের ওপর অভিমান করে সম্ভবত আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বৌঠানের মৃত্যুর পর কবি প্রকাশ করেন ভানু সিংহের পদাবলী। রাধা কৃষ্ণের প্রেমের আঙ্গিকে আসলে কবি এখানে ভানু -কাদম্বরী সম্পর্ককেই তুলে ধরেছেন। যেখানে রাধার রূপকে কাদম্বরী দেবী বলছেন মরণ তাঁর কাছে শ্যামের সমান। ভানুসিংহ বলছেন রাধা এটা তোমার মতিভ্রম। মরনকে তুমি শ্যামের সমান করছো। শ্যাম মৃত্যুর থেকে বড়ো। তুমি বিচার করে দেখো। ভানুসিংহের পদাবলী প্রমান করে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মতোই ভানু -কাদম্বরী প্রেম পবিত্র।
ভানুসিংহের পদাবলী প্রকাশের প্রায় ছয় বছর পর এক বর্ষা মুখর রাতে কবির স্মৃতিতে ধরা দেয় চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে বৌঠানের সাথে দোলনায় দোল খাওয়ার কথা। কবি লিখলেন ওগো নির্জনে বকুল শাখায় দোলায় কে আজি দুলছে দোদুল দুলছে। কবিতার নাম রাখলেন নববর্ষা। বর্ষার বর্ণনা কিন্তু ভেতরে জানিয়ে দিলেন প্রেমের সমর্পন। এর পরে প্রায় সাঁইত্রিশ বছর পর ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সাথে দেখা হওয়ার পরে কবির মনে আবার ফিরে আসে সেই পুরোনো স্মৃতি। কবি লিখলেন -সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনায়। সেই স্মৃতি টুকু ক্ষণে ক্ষনে কবির মনে আস্তে থাকে। সৃষ্টি হয় শাপমোচন নাটক।
ভানু -কাদম্বরী সম্পর্ক তাই বাস্তবের রতি দিয়ে মাপতে যাওয়া ভুল। এই প্রেমের আবেদন সাহিত্যে। তাই এই প্রেমের মৃত্যু নেই। এই প্রেম ও রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মতো অ-লৌকিক।

আমার ধর্ম মানুষ ধর্ম __ সুধাংশু চক্রবর্তী

জাতপাতের বজ্জাতিতে দেশটা ছেয়ে গিয়েছে । দুঃস্বপ্নের জালে জড়িয়ে আছে জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্ম । মানুষ পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে দুর্গতির মধ্যে । তেমন সময়েই একটা দিনে কমলা বিয়ে করে কাকার আশ্রয় থেকে স্বামীর আশ্রয়ে চলেছে চতুর্দোলায় চেপে । স্বামী অর্থবান পরমানন্দ শেঠের মেজো ছেলে ঘোড়ায় চেপে চলেছে সাথে সাথে । চতুর্দোলার আগে পিছে মোটামোটা ভোজপুরী পালোয়ান । তারা সবাই বিখ্যাত লাঠিয়াল ।
তালতাড়ির মাঠে চতুর্দোলা চলছে দুলকি চালে । হঠাৎ ‘হা-রে-রে-রে ... । সদলবলে ছুটে আসে বিখ্যাত ডাকাত মধুমোল্লার । কমলার স্বামী এবং ভোজপুরী পালোয়ানেরা নিমেষে গা ঢাকা দেয় অন্ধকারে । কমলা ভয়ে চতুর্দোলা ছেড়ে ঝোপের আড়ালে লুকোতে যাচ্ছে এমন সময়ে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায় বৃদ্ধ হবির খাঁ যাকে সবাই ভক্তি করে পয়গম্বরের মতো । মধুমল্লারকে পালিয়ে যেতে হয় শিকার ফেলে । হবির খাঁ’কে কমলা কেঁদে কেঁদে বলে – “আমি কাকার কাছে যাবো ।”
হবির খাঁ হাসেন – “আমি মুসলমান আর তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে । মুসলমানের ঘরে যেতে সংকোচ হতেই পারে । কিন্তু মা , ত্যোমাকে যে যেতেই হবে আমার সঙ্গে । সেটাই যে তোমার নিয়তি ।”
- “দয়া করে কাকাকে খবর দাও তিনি নিয়ে যাবেন আমাকে ।”
- “ভুল করছো বাছা । ওরা ফিরিয়ে নেবে না তোমাকে । একবার পরীক্ষা করে দেখো । ঘুরে এসে বাড়ী থেকে । আমি অপেক্ষায় রইলাম ।”
বেজাতের হাতে পড়া অলক্ষ্মী কমলার স্থান হয় না কাকার বাড়িতে । ফিরে এসে আশ্রয় নিতে হয় মুসলমান হবির খাঁয়ের আট-মহলা বাড়িতে । সেখানে হিন্দু হয়ে দিন কাটায় পূজা-আর্চা করে । এই কমলাই একদিন জাতপাতের বাধা দূর করে ভালোবেসে বিয়ে করে হবির খাঁ’রই মেজো ছেলে করিমকে.........।”
তড়তড় করে এগিয়ে চলছে 'মুসলমানীর গল্প' । হঠাৎ খাতার পাতা থেকে কমলা বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় গল্পকারের সামনে – “শুধু কাহিনী লিখলেই হবে ? যদি কাজেও করে দেখাতে তাহলে বুঝতাম কিছু একটা করেছো এই অসহায় সমাজের জন্য ।”
কাগজ কলম তুলে রেখে উঠে পড়লেন গল্পকার । তাই তো ! কমলা ঠিকই বলেছে । আমার ধর্ম মানুষ ধর্ম । মানুষের বাইরে আমার কোনো দেবতা নেই । মানুষ যদি স্বধর্ম পালন করে তাহলেই মানুষের ধর্ম পালন করা হয় । অথচ আমরা সেই ধর্ম পালন না করে হিন্দুধর্ম মুসলমান ধর্ম শিখধর্ম পালন করছি । তার ফলও দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেই ।
বাঙলা ভাগ কার্যকর হলো ১৬ অক্টোবর । সেদিনই সকালে গল্পকার তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে ‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল’ গাইতে গাইতে নগ্নপদে চলে এলেন জগন্নাথ ঘাটে । জগন্নাথ ঘাটে স্নান সেরে তাঁরই নেতৃত্বে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ প্রমুখেরা বাঙালি ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ রাখি পড়ালেন সকলকে । স্ট্যাণ্ড রোড দিয়ে মিছিল পাথুরেঘাটায় এলে তিনি ধনপতি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে ঢুকে মুসলমান সহিসদের হাতে রাখি পরালেন । পাথুরেঘাটা থেকে ফিরতি মিছিল কলুটোলায় নাখোদা মসজিদের দিকে গেল ।
গল্পকারের ইচ্ছা হলো শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মত হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ দূর করার জন্য নাখোদা মসজিদে গিয়ে মৌলবী নমাজী সবাইকে রাখি পড়িয়ে এই আন্দোলনে সামিল করে আন্দোলনকে হিন্দু মুসলমান সম্মিলিত আন্দোলন করে তুলবেন । সেইমতো নাখোদা মসজিদে ঢুকে সবাইকে নির্বিঘ্নে রাখি পড়িয়ে ঘরে ফিরে এসে হাঁক দিয়ে বললেন – “কী গো মেয়ে, কোথায় তুমি ? দেখলে তো শুধু কথায় নয় কাজেও করে এলাম ?”
কমলা তখন কোথায় ? খবর পেয়েছে কাকার দ্বিতীয় মেয়ে সরলার অবস্থা তাঁরই মত হতে চলেছে । সেও তার মতোই স্বামীর ঘরে যাবার পথে আক্রান্ত হতে চলেছে মধুমল্লার দ্বারা । গল্পকার যখন তাকে খুঁজছেন কমলা তখন মধুমল্লারের পেছন থেকে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে – “”খবরদার ।” পরমুহূর্তে হবির খাঁয়ের অর্ধচন্দ্র-আঁকা পতাকাবাঁধা বর্শার ফলক এসে আড়াল করে সরলাকে ।

মৃত্যু যখন জ্যোৎস্নায় আসে __ শুভশ্রী সাহা

এমন জ্যোৎস্নায় যেন মৃত্যু নেমে আসে,
রুপোলি শাড়ির পাড়ে,পাখির পালক ভালোবাসা
ছুঁয়ে যায় নদী ঘাট জলতল যাবতীয় নৈ:শব্দকে
রেখে যায় দাগ শরীরী ঠিকানায়.....

এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসোনা গল্প করি
দেখো ওই ঝিলিমিলি রাত সারা রাত আকাশের শলমা জরি, এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসোনা গল্প করি

এমন রাতে কথা বলে না ভালোবাসা, 
উজল আলোয় খোঁজে প্রিয় মুখ,
একটু পরেই চাঁদের নিজস্ব আয়নায়
চরাচর জুড়ে সেই চেনা কাশ ফুল

জাফরানী ওই আলতা ঠোঁটে, মিষ্টি হাসির গোলাপ ফোটে
মনেহয় বাতাসের ওই দিলরুবাতে সুর মিলিয়ে আলাপ করি

আহা, এমন জ্যোৎস্নাতেই যেন মৃত্যু নেমে আসে,
যে দিয়েছে আঘাত সেই ছুঁয়ে থাকে মুঠো ভরে
শ্রী রাধিকা জানে এমন আলোর মর্মকথা 
মৃত্যুকে যে দিয়েছে এমন চুম্বন গভীর আশ্লেষে

মধুচন্দ্রিমার সুর ___ মন্দিরা মিশ্র

পাহাড়ের পদতলে ‚ উন্মুক্ত আকাশের নীচে
মধুচন্দ্রিমার স্মৃতিমেদুর সেই রাতে ‚
সুধাকিরণে ভেসে যাচ্ছিল চারদিক |
পাহাড়ের গায়ে পিছলে যাওয়া আলো
আর প্রস্রবনের ঝরঝর শব্দ |
প্রগাঢ় চুম্বনে বিভোর ছিলেম জলতরঙ্গে |

আজও এই চন্দ্রিমাতে ‚ ঘুম আসেনা চোখে ‚
কিন্তু সেই পাথরে পিছলে যাওয়া ‚
ঐ জ্যোৎস্নার সাথে ফারাক অনেক ___
হেথা ধাক্কা খায় সুধাকর দেয়ালে-দেয়ালে |
বহু কষ্টে ফাঁক-ফোকর গলে ‚
ছিটেফোঁটা আলতো ছোঁয়াচ মেলে |

ছুটে যাই ঘরের কোণে ‚
সুরবাহারটা মুখথুবড়ে পড়ে আছে ‚
শতচেষ্টাতেও তারে পেলেমনা মনের কাছে |
কতদিনতো হাত পড়েনি ‚ ধুলোয় ঢেকে গেছে |

ফিরে আসি বারান্দায় ‚ 
ডুবে যাই সেই মধুচন্দ্রিমায়......

এই মনজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে
এসোনা গল্প করি |
দেখো ঐ ঝিলিমিলি চাঁদ 
সারারাত আকাশে শলমা জরি |
এই মনজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে 
এসোনা গল্প করি |
জাফরানী ঐ আলতা ঠোঁটে 
মিষ্টি হাসির গোলাপ ফোটে ‚
মনে হয় বাতাসের ঐ দিলরুবাতে 
সুর মিলিয়ে আলাপ ধরি |

অস্তিত্ব __ শর্মিষ্ঠা দত্ত


স্নেহের বাবাই , 

সামনে বিছানো আছে অন্তহীন পথ ...সেখানেই আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি আজ l আমাকে খুঁজিস না আর ...হয়ত খুঁজবিও না ...স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবি অবশেষে ...
ও বাড়িতে তোদের নিত্যদিনের অশান্তি দেখতে দেখতে প্রতিদিন মৃত্যুকে ডাকতাম আমি ; আরো বেটার লাইফস্টাইলের জন্য কখনো কখনো এক্সট্রা ডিউটি করে প্রায় মধ্যরাতে বেসামাল অবস্থায় সোনালী বাড়ি ফিরত ; হিংস্র পশুর মত তোরা ঝাঁপিয়ে পড়তিস পরস্পরের দিকে ... নিজেকে বলতাম , আর কত ? ...আরো কতদিন এই অপ্রাসঙ্গিক , অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্বটা দিয়ে নিজের সন্তানের জীবনের ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে থাকব ?
বেসামাল সোনালী যখন চোখে একরাশ ঘৃণা উগরে রিসেশনের কারণে তোর থমকে থাকা কেরিয়ারকে , তোর অকর্মণ্যতাকে তোদের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য দায়ী করত ... ওর জীবনের জটিলতার জন্য প্রত্যক্ষ্যভাবেই আমাকে দোষারোপ করত ... আমার অভিভাবকত্বের ত্রুটির কথা বলত ; তোদের সংসারে বাড়তি মেদ বলে চিহ্নিত করত আমায় ...তখন তুইও সস্তা মদের বোতল থেকে গলায় ঢেলে নিতিস ফ্রাস্ট্রেশনের বিষ ...আমার সামনেই ...আমি সহ্য করতে পারতাম না ; তোর হাত থেকে কেড়ে ফেলে দিতে যেতাম বোতলটা ...আর তোর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ত আমার ওপর l আমার হাতে ,পিঠে এখনও সেই কালশিটের দাগ ...তবু সর্বংসহা মা হয়ে বরাবর ক্ষমা করে গিয়েছি তোকে ...আমার অস্তিত্বটাকে তখন বড় অবান্তর মনে হত রে বাবাই ... আমি মরমে মরে যেতাম l
রাতের অশান্তির জেরে সকালে সোনালী বেঘোরে ঘুমোয় ...উঠতে অনেকটা দেরি হয় ; উঠেই আবার অফিস বেরোনোর তাড়া থাকে ওর ...তাই রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাইনি কোনদিনই l সকালের চা-এর কাপটা এগিয়ে দেওয়ার সময় দেখতাম তুই আর আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিস না ... চা খেয়েই বেরিয়ে যেতিস ...তারপর সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরতিস উদ্দেশ্যহীন...যতক্ষণ না ফিরতিস দুশ্চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারতাম না l সন্ধ্যেবেলা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ফেরার পর আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি...যেন একটা গোলকধাঁধায় আটকে পড়া জীবন !
আজ সন্দীপনদা এসেছিলেন...তোর প্রিয় সেই দীপনকাকু ; তোর বাবার বাল্যবন্ধু ; যাঁর কোলেপিঠে চড়ে মানুষ হয়েছিস তুই l সারাটা জীবন যিনি দ্বিধাহীনভাবে পাশে থেকেছেন আমাদের l মনে আছে ... তোর বিয়ের পর সোনালী একদিন প্রশ্ন তুলেছিল...তোর মৃত বাবার ব্যাচেলর বন্ধু কেন এখনও আমাদের বাড়ি আসেন ! ...আমি সন্দীপনদাকে একথা না বললেও হয়ত তিনি সোনালীর চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলেন ...তাই দীর্ঘ দুটো বছর পা রাখেননি এ বাড়িতে l
যোগাযোগ না থাকলেও সন্দীপনদা যে নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন সেটা আজ বুঝলাম l গত সপ্তাহে তোদের তুমুল অশান্তির জেরে প্রতিবেশীরা জড় হয়েছিল বাড়ির বাইরে ; আর আমি নিজের ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম l পরেরদিন সকালেই ফোন করেছিলেন সন্দীপনদা...জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি আবার নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চাই কি না ! আমি হেসে উঠেছিলাম ..." এই পঞ্চাশ বছর বয়েসে নতুন জীবন ! ...আমার অস্তিত্বটা নিয়ে তামাশা করছেন সন্দীপনদা ! "
সন্দীপনদা অকৃতদার হলেও তাঁর সংসারটা নেহাত ছোট নয় l অনেকদিন ধরেই জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ... এর আগে ভাসা ভাসা শুনেছিলাম একটা অনাথ আশ্রম আছে ওঁদের l বললেন , গত বছর ব্যাংকের চাকরিটা থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে এখন ওঁর সম্পূর্ণ সময়টা কাটে ওখানেই l
বারোজন শিশু-কিশোরের মা হয়ে ওঠার আবেদন রেখেছেন উনি আমার কাছে l তোদের সংসারে আমার প্রয়োজন ফুরালেও , ওদের আজ একজন মায়ের খুব প্রয়োজন l এভাবে প্রতিদিন মরে যেতে যেতে আজ একবার খুব বেঁচে ওঠার ইচ্ছে হলো রে বাবাই ! ...এই প্রথম নিজের অস্তিত্বটা যে নিরর্থক নয় সেটা অনুভব করলাম l ... মনের গোপন ঘরে প্রতিদিন যে মাতৃত্ববোধ একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল সেটাই আবার নতুন করে আঁকড়ে ধরতে চাইল আমার সন্তানদের ....হ্যাঁ ; বায়োলজিক্যালি তুই আমার একমাত্র সন্তান ....কিণ্তু আমার মাতৃত্ব যে আজ আর গন্ডীবদ্ধ নয় ; আজ বিকেলে এখানে পৌঁছানোর পর থেকেই এটা অনুভব করছি আমি ...
আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব আনন্দে সময় কাটছে আমার ...ওদের আবদার , কারণে -অকারণে "মা" বলে ডেকে ওঠা ...তোর ছোট্টবেলাটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে আমায় l ভাল আছি আমি ...খুব ভাল থাকব এখানে ...ওদের মা হয়ে নিজের জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেলাম আজ l
নিজের কেরিয়ারের থেকে তোকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম তাই উপার্জন করিনি কোনদিনই l আমার যতটুকু সঞ্চয় ; সবই তোর বাবার দান ... রেখে গেলাম তোদের জন্যই l ও টাকায় আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার l অবাঞ্ছিত অস্তিত্বটা নিয়ে চলে গেলাম ; এবার অন্তত নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ভুলে আপোস করে নিস দুজনে ...একটা শান্তির সংসার গড়ে তুলিস ...তোদের অনাগত সন্তান যেন একজন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠে l

..................সতত শুভাকাঙ্খী মা

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...