রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭

ভানু - কাদম্বরী ___ অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য

বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণের প্রেম এক শাস্ত্রীয় মর্যাদা পেয়েছে। যে প্রেম কে বাস্তবের সাথে মেলানো যায় না। অথচ বাস্তব প্রেমের সব উপাদান সেই প্রেমে আছে। পূর্বরাগ, অনুরাগ এগুলো প্রেমের এক একটা শাস্ত্রীয় পর্যায়। সব কিছুর মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের প্রেম এমন একটা শাস্ত্রীয় পর্যায় পৌঁছে গেছে যেখানে বাস্তবের সাথে অমিলটাই বেশি। কেউ বলেন রাধার সুখ অধিক কেউ বলেন রাধার অত্মসমর্পন। রাধা সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন। শাস্ত্রে যাকে বলা হয় রাগাত্মিকা অথবা রাগানুগা। সাহিত্যের দর্পনে সমাজের যে চিত্র ফুটে ওঠে সেখানে নায়ক নায়িকার মিলনের সাথে রাধা কৃষ্ণের মিলনের একটা মৌলিক পার্থক্য থেকে গেছে। বাস্তবের প্রেম লৌকিক। রাধাকৃষ্ণের প্রেম অ-লৌকিক। তাই কৃষ্ণকে বলাহয় রসরাজ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। বাংলা সাহিত্যে এরকম আর একটি সম্পর্ক আছে. রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ বা ওনার বৌঠানের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল, সেটা চর্চা করা অবান্তর। তবে সেই সম্পর্কের যে সাহিত্যিক প্রতিফলন আমরা পেয়েছি সেটা বাংলা সাহিত্যে বিরল। যা রাধা কৃষ্ণের প্রেমের সাথে সমতুল্য।
ব্যারিস্টারি পড়তে অথবা এই এ এস হতে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যান। বিদেশে পুরুষ নারীর প্রগতিশীল কালচার দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে অনেক পরিবর্তন আসে। যে পরিবর্তন ধরা পড়ে কবির লেখা তৎকালীন তেরোটি পত্রতে যেগুলো ছিন্নপত্র তে স্থান পেয়েছে। সেই সময় বিদেশী মহিলাদের সম্পর্কে কাদম্বরী দেবীর কটাক্ষের উত্তর দিতে কবি লেখেন -তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতার। পরে গানটি ব্রাম্হসংগীত হিসেবে গাওয়া হতো। অর্থাৎ প্রেম পর্যায় থেকে জন্ম নিলেও এই গানের আবেদন পূজা পর্যায় তে। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পাঁচ মাস পর কাদম্বরী দেবী জ্যোতিন্দ্রনাথের ওপর অভিমান করে সম্ভবত আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বৌঠানের মৃত্যুর পর কবি প্রকাশ করেন ভানু সিংহের পদাবলী। রাধা কৃষ্ণের প্রেমের আঙ্গিকে আসলে কবি এখানে ভানু -কাদম্বরী সম্পর্ককেই তুলে ধরেছেন। যেখানে রাধার রূপকে কাদম্বরী দেবী বলছেন মরণ তাঁর কাছে শ্যামের সমান। ভানুসিংহ বলছেন রাধা এটা তোমার মতিভ্রম। মরনকে তুমি শ্যামের সমান করছো। শ্যাম মৃত্যুর থেকে বড়ো। তুমি বিচার করে দেখো। ভানুসিংহের পদাবলী প্রমান করে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মতোই ভানু -কাদম্বরী প্রেম পবিত্র।
ভানুসিংহের পদাবলী প্রকাশের প্রায় ছয় বছর পর এক বর্ষা মুখর রাতে কবির স্মৃতিতে ধরা দেয় চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে বৌঠানের সাথে দোলনায় দোল খাওয়ার কথা। কবি লিখলেন ওগো নির্জনে বকুল শাখায় দোলায় কে আজি দুলছে দোদুল দুলছে। কবিতার নাম রাখলেন নববর্ষা। বর্ষার বর্ণনা কিন্তু ভেতরে জানিয়ে দিলেন প্রেমের সমর্পন। এর পরে প্রায় সাঁইত্রিশ বছর পর ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সাথে দেখা হওয়ার পরে কবির মনে আবার ফিরে আসে সেই পুরোনো স্মৃতি। কবি লিখলেন -সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনায়। সেই স্মৃতি টুকু ক্ষণে ক্ষনে কবির মনে আস্তে থাকে। সৃষ্টি হয় শাপমোচন নাটক।
ভানু -কাদম্বরী সম্পর্ক তাই বাস্তবের রতি দিয়ে মাপতে যাওয়া ভুল। এই প্রেমের আবেদন সাহিত্যে। তাই এই প্রেমের মৃত্যু নেই। এই প্রেম ও রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মতো অ-লৌকিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...