জাতপাতের বজ্জাতিতে দেশটা ছেয়ে গিয়েছে । দুঃস্বপ্নের জালে জড়িয়ে আছে জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্ম । মানুষ পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে দুর্গতির মধ্যে । তেমন সময়েই একটা দিনে কমলা বিয়ে করে কাকার আশ্রয় থেকে স্বামীর আশ্রয়ে চলেছে চতুর্দোলায় চেপে । স্বামী অর্থবান পরমানন্দ শেঠের মেজো ছেলে ঘোড়ায় চেপে চলেছে সাথে সাথে । চতুর্দোলার আগে পিছে মোটামোটা ভোজপুরী পালোয়ান । তারা সবাই বিখ্যাত লাঠিয়াল ।
তালতাড়ির মাঠে চতুর্দোলা চলছে দুলকি চালে । হঠাৎ ‘হা-রে-রে-রে ... । সদলবলে ছুটে আসে বিখ্যাত ডাকাত মধুমোল্লার । কমলার স্বামী এবং ভোজপুরী পালোয়ানেরা নিমেষে গা ঢাকা দেয় অন্ধকারে । কমলা ভয়ে চতুর্দোলা ছেড়ে ঝোপের আড়ালে লুকোতে যাচ্ছে এমন সময়ে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায় বৃদ্ধ হবির খাঁ যাকে সবাই ভক্তি করে পয়গম্বরের মতো । মধুমল্লারকে পালিয়ে যেতে হয় শিকার ফেলে । হবির খাঁ’কে কমলা কেঁদে কেঁদে বলে – “আমি কাকার কাছে যাবো ।”
হবির খাঁ হাসেন – “আমি মুসলমান আর তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে । মুসলমানের ঘরে যেতে সংকোচ হতেই পারে । কিন্তু মা , ত্যোমাকে যে যেতেই হবে আমার সঙ্গে । সেটাই যে তোমার নিয়তি ।”
- “দয়া করে কাকাকে খবর দাও তিনি নিয়ে যাবেন আমাকে ।”
- “ভুল করছো বাছা । ওরা ফিরিয়ে নেবে না তোমাকে । একবার পরীক্ষা করে দেখো । ঘুরে এসে বাড়ী থেকে । আমি অপেক্ষায় রইলাম ।”
বেজাতের হাতে পড়া অলক্ষ্মী কমলার স্থান হয় না কাকার বাড়িতে । ফিরে এসে আশ্রয় নিতে হয় মুসলমান হবির খাঁয়ের আট-মহলা বাড়িতে । সেখানে হিন্দু হয়ে দিন কাটায় পূজা-আর্চা করে । এই কমলাই একদিন জাতপাতের বাধা দূর করে ভালোবেসে বিয়ে করে হবির খাঁ’রই মেজো ছেলে করিমকে.........।”
তড়তড় করে এগিয়ে চলছে 'মুসলমানীর গল্প' । হঠাৎ খাতার পাতা থেকে কমলা বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় গল্পকারের সামনে – “শুধু কাহিনী লিখলেই হবে ? যদি কাজেও করে দেখাতে তাহলে বুঝতাম কিছু একটা করেছো এই অসহায় সমাজের জন্য ।”
কাগজ কলম তুলে রেখে উঠে পড়লেন গল্পকার । তাই তো ! কমলা ঠিকই বলেছে । আমার ধর্ম মানুষ ধর্ম । মানুষের বাইরে আমার কোনো দেবতা নেই । মানুষ যদি স্বধর্ম পালন করে তাহলেই মানুষের ধর্ম পালন করা হয় । অথচ আমরা সেই ধর্ম পালন না করে হিন্দুধর্ম মুসলমান ধর্ম শিখধর্ম পালন করছি । তার ফলও দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেই ।
বাঙলা ভাগ কার্যকর হলো ১৬ অক্টোবর । সেদিনই সকালে গল্পকার তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে ‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল’ গাইতে গাইতে নগ্নপদে চলে এলেন জগন্নাথ ঘাটে । জগন্নাথ ঘাটে স্নান সেরে তাঁরই নেতৃত্বে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ প্রমুখেরা বাঙালি ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ রাখি পড়ালেন সকলকে । স্ট্যাণ্ড রোড দিয়ে মিছিল পাথুরেঘাটায় এলে তিনি ধনপতি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে ঢুকে মুসলমান সহিসদের হাতে রাখি পরালেন । পাথুরেঘাটা থেকে ফিরতি মিছিল কলুটোলায় নাখোদা মসজিদের দিকে গেল ।
গল্পকারের ইচ্ছা হলো শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মত হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ দূর করার জন্য নাখোদা মসজিদে গিয়ে মৌলবী নমাজী সবাইকে রাখি পড়িয়ে এই আন্দোলনে সামিল করে আন্দোলনকে হিন্দু মুসলমান সম্মিলিত আন্দোলন করে তুলবেন । সেইমতো নাখোদা মসজিদে ঢুকে সবাইকে নির্বিঘ্নে রাখি পড়িয়ে ঘরে ফিরে এসে হাঁক দিয়ে বললেন – “কী গো মেয়ে, কোথায় তুমি ? দেখলে তো শুধু কথায় নয় কাজেও করে এলাম ?”
কমলা তখন কোথায় ? খবর পেয়েছে কাকার দ্বিতীয় মেয়ে সরলার অবস্থা তাঁরই মত হতে চলেছে । সেও তার মতোই স্বামীর ঘরে যাবার পথে আক্রান্ত হতে চলেছে মধুমল্লার দ্বারা । গল্পকার যখন তাকে খুঁজছেন কমলা তখন মধুমল্লারের পেছন থেকে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে – “”খবরদার ।” পরমুহূর্তে হবির খাঁয়ের অর্ধচন্দ্র-আঁকা পতাকাবাঁধা বর্শার ফলক এসে আড়াল করে সরলাকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন