Memory... is the diary that we all carry about with us
--Oscar Wilde
--Oscar Wilde
অনাদিকাল থেকে অনন্ত পথ ধরে বহমান জীবনধারা – অক্লান্তভাবে একই গতিতে সতত ধাবিত। সময়চক্রের জটিল ও যান্ত্রিক টানাপোড়েনে যাপনের উপলব্ধি, লক্ষ্য, অনুভব, গতিশীলতার পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বর্তমান মুহূর্তগুলো অতীতের গহ্বরে নিপতিত হয়। কিছু মুহূর্ত বিলীন হয়, প্রয়োজনীয়তা হারায়। আবার কিছু মুহূর্ত মনের মণিকোঠায় অবিনশ্বর হয়ে রয়। এই অবিনশ্বর টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোই স্মৃতি। যাপনের নানা বাঁকে অপেক্ষায় থাকে- পিছু ডাকে অবসরে বা কর্মব্যস্ততার মাঝে... নির্জনে অথবা সকলের মাঝে।
স্মৃতির প্রতিটি অলিন্দে লুকিয়ে থাকা টুকরো সুখগুলোই আমার যাপনের ক্লেশ দূরীভূত করে। অবসন্নতায়ও ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি যোগায়। সেই সুখ স্মৃতির অন্বেষণের মাঝে কখনও অতীত গহ্বর থেকে যদি ভেসে আসে বিষাদের কালো মেঘ, আমি তাকে এক নিমেষে উড়িয়ে দিই... পাঠিয়ে দিই দীপান্তরে। তবুও কিছু একগুঁয়ে কালো মেঘ কখনও উঁকি মারে মন আঙ্গিনায়। তেমনি এক মেঘের নাম ছিল "সিমকি সরকার।"
সিমকি আমার কলেজ জীবনের দুটি বছর আমায় জড়িয়ে ছিল ছায়ার মত- নীরবে, নিজের অস্তিত্ব তেমনভাবে জাহির না করেই। কলেজ জীবন মানে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণী। আমাদের সময় বাংলাদেশে স্কুল লেভেল ছিল দশম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপরের দুটি শ্রেণী কলেজ..... অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়। সিমকি সরকারের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত কিভাবে তা আর আজ মনে পড়ে না। এটুকুই মনে আছে-- কলেজে ওর সাথেই আমার প্রথম পরিচয়। আর প্রথম দিনটি থেকেই মেয়েটি আমার ছায়াসঙ্গী।
চার ফুট আট ইঞ্চির গোলগাল অবয়ব আর চোখে পাওয়ারফুল ভারী ফ্রেমের চশমা পরিহিতা মেয়েটি ঠিক কোন রসায়নে আমাকে নির্ভরযোগ্য বন্ধু মনে করেছিল আজও তা আমার কাছে রহস্যময়। মূলত সিমকি আর আমি চরিত্রগত দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্হান করতাম। সিমকির গাম্ভীর্য, মেপে কথা বলা, অর্থোডক্স জীবনবোধের কারণে আমি ওর বন্ধুত্বকে ঠিক সেভাবে বরণ করি নি কখনও.... ওকে উপেক্ষাও করি নি কোনদিন অবশ্য।
তখন "চাইল্ড সাইকোলজি," "এডলোসেন্স বিহেভিয়ার" এসব নিয়ে এত প্রচার ছিল না... থাকলে হয়তো সিমকিরাও হাসতে শিখতো, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে শিখতো, ভালবাসতে শিখতো নিজেকে.. অন্য সবাইকেও।
কলেজের দুটি বছর শেষ হওয়ার পথে সিমকি একদিন জানালো মেসোমশায় অর্থাৎ ওর বাবা সেদিন ইন্ডিয়া বেড়াতে যাচ্ছেন -ওর পিসি আর কাকু কলকাতায় থাকেন....তাঁদের কাছেই থাকবেন উনি। এটা ওর একটুও পছন্দ নয়। কাকতালীয়ভাবে উনি আর ফিরে যান নি সিমকিদের কাছে বাংলাদেশে, পনেরো দিন পর ফিরেছিল শুধু উনার ব্যবহার্য পোশাক, ঘড়ি আর চশমা। আর একটি চিঠি, শবদেহ পাঠানোর বিড়ম্বনা এড়াতে উনার সৎকার কলকাতায় করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হঠাৎ স্ট্রোক বলা হলেও সিমকি মানতে নারাজ। মাসিমণিকে কোন আচার মানতে দেয় নি ও। ওর স্থির বিশ্বাস ছিল উনি জীবিত।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমার আর সিমকির সাথে যোযোগাযোগ হয়নি। ও আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল.. আরও বেশি অন্যরকম .. যেটা আমাদের ঐ বয়সের সাথে সতত বেমানান। তাই হয়তো আমার দিক থেকেও যোগাযোগের কোন তাগিদ ছিলনা। জানতাম, সিমকি সিলেট মেডিকেলে পড়ে। শুনেছিলাম, ও ছুটিতে বাড়ি আসে না। এসব খবরের কোনটাই তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি কখনও। যেদিন শুনলাম, সিমকি আর নেই.... প্রচন্ড জ্বরে হস্টেলেই নিজের রুমেই সবার অজান্তেই ছেড়ে গেছে পৃথিবী .... যার প্রতি কোন মায়া ওর কস্মিনকালেও ছিল না।
জানি না কেন সেদিন চোখের জলে ভেসেছিলাম। আমি তখন বিয়ে করে কলকাতাবাসি। শুনেছিলাম, মেডিকেলে পড়ার সময় ও যে ওষুধ নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পেতো, সেটাই try করতো নিজের উপর... বড় বেশি উদাসীন ছিল নিজের প্রতি!
ততদিনে আমি কিন্তু জেনে গেছি, আত্মপ্রেমের কারণ যেমন ভালোবাসা তেমনি আত্ম-উদাসীনতা আসে ভালোবাসাহীন যাপন থেকে। সেই থেকে বিবেকের কাঠগড়ায় প্রতিনিয়ত মাথা কুটে চলেছি... সিমকি আমায় বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো, আমি যদি নিজেকে দূরে না সরিয়ে নিতাম, হয়তো এভাবে অকালে ঝরে যেতোনা মেয়েটি! সবাই জানে আমি বন্ধু বৎসল.. কেউ জানে না একটি "তথাকথিত অন্যরকম" মেয়ের বন্ধুত্বের মূল্য দিইনি অপরিণত এই আমি!
সিমকির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি প্রতি মুহূর্তে। আর্জি জানাই আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করে দিও সিমকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন