রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭

অস্তিত্ব __ শর্মিষ্ঠা দত্ত


স্নেহের বাবাই , 

সামনে বিছানো আছে অন্তহীন পথ ...সেখানেই আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি আজ l আমাকে খুঁজিস না আর ...হয়ত খুঁজবিও না ...স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবি অবশেষে ...
ও বাড়িতে তোদের নিত্যদিনের অশান্তি দেখতে দেখতে প্রতিদিন মৃত্যুকে ডাকতাম আমি ; আরো বেটার লাইফস্টাইলের জন্য কখনো কখনো এক্সট্রা ডিউটি করে প্রায় মধ্যরাতে বেসামাল অবস্থায় সোনালী বাড়ি ফিরত ; হিংস্র পশুর মত তোরা ঝাঁপিয়ে পড়তিস পরস্পরের দিকে ... নিজেকে বলতাম , আর কত ? ...আরো কতদিন এই অপ্রাসঙ্গিক , অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্বটা দিয়ে নিজের সন্তানের জীবনের ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে থাকব ?
বেসামাল সোনালী যখন চোখে একরাশ ঘৃণা উগরে রিসেশনের কারণে তোর থমকে থাকা কেরিয়ারকে , তোর অকর্মণ্যতাকে তোদের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য দায়ী করত ... ওর জীবনের জটিলতার জন্য প্রত্যক্ষ্যভাবেই আমাকে দোষারোপ করত ... আমার অভিভাবকত্বের ত্রুটির কথা বলত ; তোদের সংসারে বাড়তি মেদ বলে চিহ্নিত করত আমায় ...তখন তুইও সস্তা মদের বোতল থেকে গলায় ঢেলে নিতিস ফ্রাস্ট্রেশনের বিষ ...আমার সামনেই ...আমি সহ্য করতে পারতাম না ; তোর হাত থেকে কেড়ে ফেলে দিতে যেতাম বোতলটা ...আর তোর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ত আমার ওপর l আমার হাতে ,পিঠে এখনও সেই কালশিটের দাগ ...তবু সর্বংসহা মা হয়ে বরাবর ক্ষমা করে গিয়েছি তোকে ...আমার অস্তিত্বটাকে তখন বড় অবান্তর মনে হত রে বাবাই ... আমি মরমে মরে যেতাম l
রাতের অশান্তির জেরে সকালে সোনালী বেঘোরে ঘুমোয় ...উঠতে অনেকটা দেরি হয় ; উঠেই আবার অফিস বেরোনোর তাড়া থাকে ওর ...তাই রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাইনি কোনদিনই l সকালের চা-এর কাপটা এগিয়ে দেওয়ার সময় দেখতাম তুই আর আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিস না ... চা খেয়েই বেরিয়ে যেতিস ...তারপর সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরতিস উদ্দেশ্যহীন...যতক্ষণ না ফিরতিস দুশ্চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারতাম না l সন্ধ্যেবেলা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ফেরার পর আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি...যেন একটা গোলকধাঁধায় আটকে পড়া জীবন !
আজ সন্দীপনদা এসেছিলেন...তোর প্রিয় সেই দীপনকাকু ; তোর বাবার বাল্যবন্ধু ; যাঁর কোলেপিঠে চড়ে মানুষ হয়েছিস তুই l সারাটা জীবন যিনি দ্বিধাহীনভাবে পাশে থেকেছেন আমাদের l মনে আছে ... তোর বিয়ের পর সোনালী একদিন প্রশ্ন তুলেছিল...তোর মৃত বাবার ব্যাচেলর বন্ধু কেন এখনও আমাদের বাড়ি আসেন ! ...আমি সন্দীপনদাকে একথা না বললেও হয়ত তিনি সোনালীর চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলেন ...তাই দীর্ঘ দুটো বছর পা রাখেননি এ বাড়িতে l
যোগাযোগ না থাকলেও সন্দীপনদা যে নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন সেটা আজ বুঝলাম l গত সপ্তাহে তোদের তুমুল অশান্তির জেরে প্রতিবেশীরা জড় হয়েছিল বাড়ির বাইরে ; আর আমি নিজের ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম l পরেরদিন সকালেই ফোন করেছিলেন সন্দীপনদা...জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি আবার নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চাই কি না ! আমি হেসে উঠেছিলাম ..." এই পঞ্চাশ বছর বয়েসে নতুন জীবন ! ...আমার অস্তিত্বটা নিয়ে তামাশা করছেন সন্দীপনদা ! "
সন্দীপনদা অকৃতদার হলেও তাঁর সংসারটা নেহাত ছোট নয় l অনেকদিন ধরেই জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ... এর আগে ভাসা ভাসা শুনেছিলাম একটা অনাথ আশ্রম আছে ওঁদের l বললেন , গত বছর ব্যাংকের চাকরিটা থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে এখন ওঁর সম্পূর্ণ সময়টা কাটে ওখানেই l
বারোজন শিশু-কিশোরের মা হয়ে ওঠার আবেদন রেখেছেন উনি আমার কাছে l তোদের সংসারে আমার প্রয়োজন ফুরালেও , ওদের আজ একজন মায়ের খুব প্রয়োজন l এভাবে প্রতিদিন মরে যেতে যেতে আজ একবার খুব বেঁচে ওঠার ইচ্ছে হলো রে বাবাই ! ...এই প্রথম নিজের অস্তিত্বটা যে নিরর্থক নয় সেটা অনুভব করলাম l ... মনের গোপন ঘরে প্রতিদিন যে মাতৃত্ববোধ একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল সেটাই আবার নতুন করে আঁকড়ে ধরতে চাইল আমার সন্তানদের ....হ্যাঁ ; বায়োলজিক্যালি তুই আমার একমাত্র সন্তান ....কিণ্তু আমার মাতৃত্ব যে আজ আর গন্ডীবদ্ধ নয় ; আজ বিকেলে এখানে পৌঁছানোর পর থেকেই এটা অনুভব করছি আমি ...
আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব আনন্দে সময় কাটছে আমার ...ওদের আবদার , কারণে -অকারণে "মা" বলে ডেকে ওঠা ...তোর ছোট্টবেলাটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে আমায় l ভাল আছি আমি ...খুব ভাল থাকব এখানে ...ওদের মা হয়ে নিজের জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেলাম আজ l
নিজের কেরিয়ারের থেকে তোকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম তাই উপার্জন করিনি কোনদিনই l আমার যতটুকু সঞ্চয় ; সবই তোর বাবার দান ... রেখে গেলাম তোদের জন্যই l ও টাকায় আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার l অবাঞ্ছিত অস্তিত্বটা নিয়ে চলে গেলাম ; এবার অন্তত নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ভুলে আপোস করে নিস দুজনে ...একটা শান্তির সংসার গড়ে তুলিস ...তোদের অনাগত সন্তান যেন একজন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠে l

..................সতত শুভাকাঙ্খী মা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...