আসুন, একটা আষাঢ়ে গল্প বলি...শুনবেন?
সমুদ্রের মাঝে একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপে একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে বাস করে একটি পরিবার, বড় এবং একান্নবর্তী। অবশ্য এক বাড়িতে না থেকে তাদের উপায়ও নেই, ওইটুকু দ্বীপের বাকি জায়গায় কোনমতে কিছু ফসল ফলিয়ে, বৃষ্টির জল ধরে রেখে ও ঝরণার জল ব্যবহার করে, সামুদ্রিক মাছ আর গাছের ফলমূল দিয়ে কোনমতে জীবনধারণের কাজটা চলে। অতএব অন্যত্র স্থানান্তরের সুযোগও নেই।
প্রশ্ন উঠবে - দ্বীপে মানুষ এল কিকরে, তাও গোটা পরিবার? ধরে নিন - বহু শত বছর আগে কিছু মানুষ জাহাজডুবির ফলে এসে পড়েছিল এই দ্বীপে। তাদেরই উত্তরসূরীরা আজ এই পরিবার। এর পরের বাকি অং বং প্রশ্নগুলো!! বলেছি না এটা আষাঢ়ে গল্প...কিছুটা নিজেরাও কল্পনা করে নিন, অঙ্কের সেই তথাকথিত কুখ্যাত তৈলাক্ত বাঁশ বাওয়া বাঁদর বা ফুটো চৌবাচ্ছার মত।
যাঈ হোক, সেই একান্নবর্তী পরিবারে, অন্য সব পরিবারের মতনই - ঝগড়াঝাঁটি, ফ্যাসাদ, মতান্তর, লড়াই, ঝগড়া, মারপিটও হয়েই থাকে। হয়ত গোটাকয়েক খুনকখারাপিও হয়ে গেছে গত কয়েক শত বছরে (বড়ই অপ্রীতিকর ব্যাপার স্যাপার বটে, কিন্তু ম অনিবার্য ও অপরিহার্য...বুঝতেই তো পারছেন)। বিভিন্ন বিষয়ে ভেদাভেদের কারণে একই বাড়ির মধ্যে থেকেও নানারকম দল, গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে। কারও সাথে কারও মুখ দেখাদেখী বন্ধ, তো কারও সাথে গলায় গলায় দোস্তি। কোথাও পিঠে ছুরি মারা তো কোথাও অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। এমনই বৈচিত্রময় সামাজিক অবকাঠামো ও পারস্পরিক নির্ভরশীল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এই দ্বীপবাসীর জীবন কাটে।
কিন্তু, তবু তাদের জীবন থেমে থাকেনি, তার কারণ জীবনধারণের সবরকম উপাদান তারা সংগ্রহ করতে পারছিল সেই দ্বীপ ও তার পারিপার্শ্বিক থেকে। দ্বীপটির কল্যাণেই বংশগতির ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু, ওই যে বলে...ভাল থাকা মানুষের পোষায় না। কিছু অর্বাচীন প্রতিহিংসা পরায়ণ দ্বীপবাসী ঠিক করল, বাকিদের জব্দ করতে হবে। কিকরে? তাদের মাথায় খেললো যুগান্তকারী মতলব...আস্তে আস্তে দ্বীপের খাদ্য ও পানীয়ের উৎসগুলিকে দূষিত করতে শুরু করল। এছাড়া দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ ইত্যাদি দিয়ে তারা যে ক্ষেত খামার নানান ব্যবস্থা করেছিল, সেগুলিতে শুরু করল অন্তর্ঘাত। ফলত - দ্বীপবাসীদের জীবনে ঘনিয়ে আসতে শুরু করল অন্তিম বিপর্যয়।
ভাবছেন, এ আবার হয় নাকি? কথায় নাকি বলে, নিজের ভাল নাকি পাগলেও বোঝে। খাবার, জল ইত্যাদির উৎস দূষিত করলে নিজেরা খাবে কি, বাঁচবে কিসে? তাছাড়া বাঁধ ইত্যাদি ভেঙে টেঙে দিলে দ্বীপটাই তো আবার আস্তে আস্তে জলের নীচে তলিয়ে যাবে। কিন্তু এ আকাটদের বোঝাবে কে? ওই যে 'কথাতেই' তো আবার বলে - নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ...ইত্যাদি ইত্যাদি।
এদ্দূর পড়ে নিশ্চয় ভাবছেন - এ গোমুখ্যুটা আষাঢ়ে গল্পের নামে আর কত গাঁজা দেবে? গল্পের গরু কি গাছে চড়ার জায়গায় আজকাল স্পেশশিপ চালাচ্ছে...অ্যাঁ!! তাহলে সুধী পাঠক, আসুন ভণিতা তথা আষাঢ়ে গল্পের সীমা ছেড়ে সাদাটে ভাষায় কিছু আলোচনা করা যাক।
কল্পনা করুন, বাড়িটি দেশ/মহাদেশ, দ্বীপটি পৃথিবী ও দ্বীপবাসীদের মানবজাতি হিসেবে। মানুষে মানুষে মতভেদ, বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি চলছে সেই আদিকাল থেকে। যতই অস্বীকার করি না কেন, এই মানুষের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা টিকে রয়েছে, তার কারণ বাঁচার রসদ এখনও নির্মূল হয়ে যায়নি।
গত কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ বহু যুদ্ধ লড়েছে, বহু বিভৎস হত্যালীলা ঘটিয়েছে বারেবারে, অনেক জাতি-উপজাতি-ভাষা-সংস্কৃতি মুছেও গেছে পৃথিবীর বুক থেকে।
আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি একবারও বলছি না যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ধর্মের নামে হানাহানি, অপরের জায়গা ও অধিকার দখনের জন্য যুদ্ধ, অন্ধ হিংসা, গোঁড়ামি..এসব সমর্থনযোগ্য। এক গন্ডমূর্খ ও পিশাচ ছাড়া কোন মানুষই এসব সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু, বাস্তবকে স্বীকার করে বলতেই হচ্ছে...এসব ছিল, আছে এবং থাকবে। আদিকাল থেকে বুদ্ধ-যিশু-মহাবীর-শ্রীচৈতন্য ইত্যাদিরা ভেদাভেদ হানাহানি রক্তপাত বিভেদ ঠেকাবার, শান্তি প্রতিষ্ঠার অনেক তো চেষ্টা করেছেন....সম্পূর্ণ সফল কেউ হতে পেরেছেন কি? হয়ত বলবেন....অতীতে পারেনি তো কি হয়েছে, মানবসভ্যতা তো এখনও উন্নয়নশীল। ভবিষ্যতে নিশ্চয় এই ঝগড়া লড়াই যুদ্ধ হিংসা মুছে গিয়ে পৃথিবীতে অখন্ড শান্তি বিরাজ করবে, মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিশ্বাস করুন, এই আশ্বাসে ভরসা রাখতে আমি প্রাণপণ উৎসাহী। কিন্তু তার জন্য মানবসভ্যতাকে সেই ভবিষ্যৎ অবধি টেকার সুযোগটুকু তো দিতে হবে!
আজ আমরা যে হারে এই গ্রহের বুকে পরিবেশকে দূষিত করে চলেছি...প্রশ্ন জাগে, মানবসভ্যতা সেই আকাঙ্খিত ভবিষ্যৎ পর্যন্ত টিকবে তো? আমরা ভুলে গেছি, এই গ্রহ ছেড়ে অন্যত্র অপসরণের সুযোগ এখনও আমাদের নেই। এইই আমাদের একমাত্র ঘর, যা এবং যেটুকু এর বুকে রয়েছে সেই রসদটুকুই আমাদের সম্বলমাত্র। তাকে মাত্রাজ্ঞানবিহীনভাবে বেপরোয়া ধ্বংস করে চললে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচবে কিসের সাহায্যে? এ কি সেই 'নিজের পায়ে কুড়ুল মারা'র পরিণতির দিকেই এগোচ্ছি না আমরা?
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়ার। দেরী হয়েছে, কিন্তু শেষ সুযোগ হাতছাড়া করলে...পরিবেশ হয়ত তার নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেবে, নিজের বুক থেকে মানুষ নামের এই পরজীবি ভাইরাসটিকে নিঃশেষে নির্মূল করে।
আর পৃথিবীরই বা দরকার কি, মানবসভ্যতা আলোকিত ভবিষ্যৎ দেখার সুযোগ পাবে না, সে পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বড় হুমকি মানুষ নিজেই। তার যুদ্ধপ্রবৃত্তির সাথে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার মিলে...কোন এক উন্মাদ মুহুর্তে একটি বোতামের চাপ, ধ্বংস করে দেবে এই বিশেষ প্রাণীকূলকে। প্রচলিত অস্ত্রে ব্যবহারে মানুষ প্রজাতিকে সমূলে নির্মূল করতে যে সময় দরকার, তার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবেই। কিন্তু এক্ষেত্রে, শুভবুদ্ধির লেশমাত্র মগজে পৌঁচানোর আগেই উপরওয়ালার দরবারে কড়া নাড়তে পৌঁছে যাবে তাবৎ নরকুল।
তাই, এক্ষণে আমাদের আশু প্রয়োজন, নিজের ঘর গুছোনোর। খাল কেটে আনা কুমীরটি যে আজ নয়ত কাল আমাকেই খাবে, এ বুদ্ধির উদ্ভব হলে হয়ত ভবিষ্যৎ একটা সুযোগ পাবে...নতুন জাগরণের। তার আগে দরকার ঘর পরিষ্কারের, যে থালায় খাচ্ছি তাতে ছিদ্র করা সর্বাগ্রে বন্ধ করা প্রয়োজনীয়। নাহলে, নিরূপায় ওই দ্বীপবাসীর মত...আমাদেরও ডুবে ছাড়া অন্য গতি থাকবে না।
যাওয়ার মত জায়গা কিন্তু আমাদেরও কোথাও নেই।