কাদের বাচ্চাটা ওখানে গাছের নীচে বসে কাঁদছে? লোভে চোখ চকচক করে ওঠে জুলির। ফিরছিলো নবীপুরের মেলা থেকে। আজ ওখানে কোন বেওয়ারিশ বাচ্চা ও পায় নি। এখানে এইভাবে বাচ্চা পাওয়া যাবে ও আশাও করে নি। খোদা যখন দেন, ছপ্পড় ফুঁড়েই দেন। গ্রামের দিকে পড়তি বিকেল। এমনিতেই লোকজনের আনাগোনা কম। আশেপাশে কেউ নেই দেখে সন্তর্পণে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে এদিক ওদিক দেখে কোলে তুলে নেয় জুলি। জুলির পরণে আটপৌরে শাড়ি, হাতে একটা ঝোলা, তাতে টুকিটাকি জিনিষপাতি। ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা লেবঞ্চুস বের করে বাচ্চাটার মুখে ধরিয়ে দেয় জুলি। কান্নাটা এতেই বন্ধ হয়ে যায় বাচ্চাটার।
বছর দু’ আড়াই বয়স হবে বাচ্চাটার। মেয়ে। জুলির কোলে উঠেই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে কচি কচি দুটো হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। এই বয়সের বাচ্চাই পাচার করা সহজ। নিজেরা মুখে তো কিছু বলতে পারে না। দত্তকের জালি কাগজ তৈরি করে চালান হয়ে যায় কাঁহা কাঁহা মুল্লুক। তারপরে তাদের কি হয়, জুলি জানে না, জানতে চায়ও না। ওর দায়িত্ব শুধুমাত্র বিভিন্ন মেলা, রেল স্টেশন, ইত্যাদি জায়গা থেকে বাচ্চা চুরি করে অনাথ আশ্রমটায় এনে দেওয়া।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।বাচ্চাটাকে কাঁখে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালায় জুলি। আলো কমে এসেছে। রাত বাড়ার আগে অনাথ আশ্রমটায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আর কোন ভয় নেই। চল্লিশ পঞ্চাশটা বাচ্চার মধ্যে লুকিয়ে ফেলা যাবে সহজেই। অনেক সময় এমন বাচ্চা তোলার পরে পরেই পুলিশের ঝামেলা হয়, খোঁজখবর শুরু হয়ে যায় সাথে সাথেই।
গ্রামের রাস্তা। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। আর সাথে সাথে চারপাশে অন্ধকারের একটা ঘেরাটোপ নেমে এলো। যদিও জুলির রাস্তাটা মুখস্থ, কিন্তু, অাজ কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে পুরো রাস্তাটা। বাঁকিপুরের রাস্তাটা যেখান থেকে ভাগ হয়েছে, ওখানে একটা চায়ের ছোট্ট দোকান ছিলো। জুলি একটু চিন্তায় ছিলো, দোকানি তাকে আবার দেখে না ফেলে। তাই সে মোড়টা আসার একটু আগে রাস্তা ছেড়ে পাশের মাঠের মধ্যে নেমে পড়লো। উদ্দেশ্য আর কিছুই না, দোকানের পিছন দিক থেকে সন্তর্পনে রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়ে একটু এগিয়ে ফের রাস্তায় উঠবে। কিন্তু, মোড়ের কাছে এসে সে দেখলো, কোথায় দোকান, কোথায় কি? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর ঐ পাকুড় গাছটা আবার ওখানে কোথা থেকে এলো? সে কি তাহলে রাস্তা ভুল করলো নাকি? তাই বা কি করে হয়? সোজা রাস্তা থেকে একবারও তো জুলি কোনদিকে বাঁকে নি। আবোল তাবোল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জুলি রাস্তায় উঠে এসে আবার পা চালায়।
আরো খানিকক্ষণ হাঁটার পরেও যখন অনাথ আশ্রমের বোর্ড দেখতে পেল না, তখন জুলি চিন্তায় পড়ে গেল। ওর মনে হতে লাগলো ও যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটেই চলেছে, এ হাঁটা ওর আর ফুরাবে না। কোলের বাচ্চাটাও যেন বড় চুপচাপ। সেই যে একটা লেবঞ্চুস পেয়ে চুপ করেছিলো, আর রা কাড়েনি এতক্ষণেও। ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়, জুলি ভাবে, অন্ধকারে বোঝার ও উপায় নেই।
এই তো!, ঠিক রাস্তাতেই ও এসেছে। অনাথ আশ্রমের একটু আগে একটা কবরস্থান ছিলো। বাইরে থেকে দুটো বিশাল গাছ দেখা যায়। ঐ তো আকাশের সামনে কালো দুটো গাছের ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর ঐ ছায়া দুটোর আকারও ওর বেশ পরিচিত, এতদিন ধরে এ এ রাস্তায় যাচ্ছে আসছে। এরপরেই একটা বাঁক পেরোলেই অনাথ আশ্রমের গেট। একটু তাড়াতাড়িই পা চালায় ও।
হঠাৎ তলপেটে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করায় নীচের দিকে তাকায় জুলি। আবছা আলোয় দেখে, একি, ছোট্ট বাচ্চাটার পা টা এত বড় কি করে হলো? সভয়ে জুলি দেখে বাচ্চাটার ডান পা তার চোখের সামনে সড়সড় করে বড় হয়ে জড়িয়ে ধরছে তাকে। একই সাথে বাঁ পা পিছন থেকে ঘুরে সামনে এগিয়ে আসছে। গলায় একটা চাপও অনুভব করে সে। বুঝতে পারে কচি হাত দুটোও বড় আর শক্তিশালী হচ্ছে দ্রুত। গলায় আর তলপেটে সাপের মতো জড়িয়ে ধরে তারা। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় জুলির, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বাচ্চাটা যেন অসম্ভব ভারীও হয়ে গেছে ওজনে। জুলি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাচ্চাটাকে কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করে সে বোঝে তা সম্ভব নয় আর। পা ভেঙে রাস্তার পাশে বসে পড়ে সে। "বাঁচাও, বাঁচাও" বলে চিৎকার করতে গিয়ে বুঝতে পারে, দমবন্ধ হয়ে এসেছে, গলা দিয়ে আওয়াজ আর বেরোচ্ছে না। দরদর করে ঘাম হতে থাকে। চোখদুটো মনে হচ্ছে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। বুকে একটা অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে জুলির। মনে হয় যেন বুক ফেটে যাবে। একটু হাওয়া, একটা নিঃশ্বাসের জন্য ও আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কিন্তু সেই শ্বাস আর তার নেওয়া হয় না। হাত দুটোর আলিঙ্গনপাশ আরো দৃঢ় হতে থাকে তার কন্ঠের উপর। জুলির থাইরয়েড কার্টিলেজ ভেঙ্গে হাইঅয়েড বোনের একটা অংশ শ্বাসনালীর মধ্যে ঢুকে ওটাকে বন্ধ করে দেয়। চোখ দুটো পিংপং বলের মতো ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে।
মারা যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে জুলি বাচ্চাটার গলায় খলখল করে হাসি শুনতে পায়। একইসঙ্গে পঞ্চাশটা বাচ্চা যেন হাসছে। এতদিন ধরে পাচার করে দেওয়া বাচ্চাগুলোর কথা তার আবছা মনে পড়ে, আর, এই প্রথমবার, তাদের জন্য দুঃখবোধ হয় তার।