রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে


উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব্যস্ত । বাতাসে এখন হাল্কা হিমেল স্পর্শ , সাথে মনটাও খানিক উড়ুউড়ু ... কার্তিকের মিঠে রোদ গায়ে মেখে ।

মন এখন দ্বিধাহীন
আঙ্গুলের চাপে ফেলে আসা দুপুর ভাঙা আলো
এখন কমলা সূর্যাস্তের সাথে মিঠে আলাপে মগ্ন

এরই মধ্যে পায়ে পায়ে রোদ্দুর পেরিয়ে এলো গোটা দুটি বছর । ২৬ শে মার্চ ২০১৫ য় হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে যে ব্যতিক্রমী গ্রুপের জন্ম হয়েছিল , আজ তার বয়স দু বছর আট মাস । রোদ্দুরের পথচলায় যারা সঙ্গে ছিলেন , আছেন এবং থাকবেন , সকল কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই । আগামী বছর রোদ্দুর পা রাখছে আরও বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে , ডানা মেলছে সাহিত্যের নতুন দিশায় । আশা রাখছি রোদ্দুরের এই নব কর্মক্ষেত্রে একই ভাবে পাশে পাবো আপনাদের ।

ভাল থাকুন সকলে । লেখায় থাকুন ।

শুভেচ্ছান্তে
পিয়ালী বসু


বিবর্তন - বেদব্রত বসু

লিখেছেন এক কবি, 'জল্পনা' থেকে 'জাল্পনিক',
ইনাম দেবো ভাবছি তাঁকে, গোটাকয়েক মালপো নিক,
ভাষার এই বিবর্তনে
হল্লা বন্ধ করতো! নে,
হাবিজাবি এই লেখার, 'সব চরিত্র কাল্পনিক' ! 

শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭

একলা বেশ - মন্দিরা মিশ্র

যতই ভাবি , একলা আছি- এইতো বেশ
কোথায় যেন খটকা লাগে_ একটা রেশ
তোমার কথা সদাই যেন কানে-বাজে
চাইনা যতই সরিয়ে দিতে , তোমার স্মৃতি

সময় সবার কাছেই বড় জরুরী
সময়ই পারে ভুলিয়ে দিতে সবকিছু ,
সরিয়ে দেয় সব যাতনা সব-ক্লেশ
তাইতো ভাবি একলা আছি , এইতো বেশ

"এই একলা ঘরে আমার দেশ
আমার একলা থাকার অভ্যেস
ভাবি , কিছুতেই ভাববোনা তোমার কথা
বোবা টেলিফোনের পাশে বসে " 

হঠাৎ যদি ফোনটা এখন শব্দ করে
বেজে ওঠে ঝনঝনিয়ে বিরাট জোরে
তোমার গলা ভাসে যদি আমার কানে
এসব আবার ভাবছি কেন , এইতো আছি একলা বেশ

সান্ত্বনা - সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

জোড়হাত করে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে অখিলেশ জানা রোজকার মতো বিড়বিড় করে বলতে থাকেন –”ওঁ জবাকুসুম......।” ভোরে ছাদে উঠে সূর্য প্রণাম সেরে প্রাত্যহিক কাজ শুরু করেন তিনি । এই নিয়ে রোজ ঝামেলা হয় স্ত্রীর সঙ্গে । আজও তার ব্যতিক্রম হয় না । 

অখিলেশ জানাকে নেমে আসতে দেখেই কণিকা খড়খড়ে গলায় উগড়ে দেন রোজকার বলা সেই একই কথা – “সূর্যপ্রণাম সেরে এতক্ষণে বাবুর আগমন ঘটলো ? এতো সূর্যপ্রণামের ঘটা কেন বাপু ? তোমার অতি ভক্তি দেখে সূর্যের তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ । তা নয় বাবু এখন আকাশে উঠে দিনভর ছড়ি ঘোরাতে থাকবেন সকলের মাথার ওপর ।” 

“আহঃ কণিকা । রোজ রোজ এককথা......” 

অখিলেশ জানার মৃদু প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা মাঝপথে বিফলে গেল । তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কণিকা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন – “লোকে বলে সূর্যপ্রণাম করলে নাকি উৎকৃষ্ট.....”

“আহঃ ,তুমি থামবে ?” অখিলেশ জানা বিরক্ত হন ।

“কি ভেবেছো তুমি, অ্যাঁ ? আমাকে থামিয়ে দিলেই কি সুখ্যাতির মগডালে চেপে বসবে ভেবেছো ? এই নিরপত্তাহীন জীবন কাটাতে কাটাতে আমি অতিষ্ট হয়ে পড়েছি । যতই ভাবি এবার নিশ্চয়ই ব্যবসাটার পতন রোধ করতে পারবে ঈশ্বরের কৃপায় । কিন্তু তেমন লক্ষণই যে দেখছি না । বরং এই পতন দেখতে দেখতেই একদিন মৃত মানুষে তালিকায় নাম লেখাতে হবে আমাকে ।” 

বড় দুঃখে কথাকয়টা বলে নিজের শাড়ীর ছেঁড়া আঁচলে চোখ মোছেন কণিকা । অখিলেশ জানার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে দেখে । সত্যিই তো । এতো চেষ্টা করেও ব্যবসাটাকে কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছেন না । অথচ বিমান, সুবিমল – ওরা কিন্তু দিব্যি দাঁড়িয়ে গিয়েছে এই একই ব্যবসায় । কণিকা ঠিকই বলেছে । যতই পূজোপার্বণ নিয়ে মেতে থাকি না কেন আমাকে যে এই বেহাল অবস্থাতেই আমৃত্যু থেকে যেতে হবে । 

ধীর পদক্ষেপে মূর্ত প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ক্রন্দনরত কণিকার কছে এসে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধীর গলায় বলেন – “ভাগ্যকে মেনে নাও কণিকা । এই জীবনে হলো না ঠিকই তবে পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে দেখে নিও আমাদের এই সাধনা বিফলে যায়নি ।”

দিনের শেষে - চন্দ্রিমা গুপ্ত

বেশ ব্যস্ততা ছিল সেই সময়টায়......শমিতার হাঁক ডাক, বাজার ঘাট করা, নাতিদের স্কুলবাসে তুলে দেওয়া, ওদের সঙ্গ দেওয়া ....এমনিভাবে কখন যে পার হয়ে যেত সময়! ছেলে ছেলের বউ যদিও বাড়িতে খুব কম সময় থাকত চাকরি ও আরো বিভিন্ন কারণে, তবে যেটুকু সময় থাকত জমিয়ে রাখত...একবার সিদ্ধেশ্বরবাবুকে জিন্সের প্যান্ট আর টি সার্ট পড়িয়ে ছেড়েছিল বৌমা! মেয়ের মত একমাত্র বৌমার আবদার রাখতে ওই পোশাক পড়ে সত্তর পেরিয়ে যাওয়া নিজেকে কেমন জোকার মনে হয়েছিল সিদ্ধেশ্বরবাবুর,সেদিন তবু বেশ লাগছিল ভাবতে বড় বড় পকেটওলা প্লেট দেওয়া ট্রাউশার পড়া বাবুটি চাপা জিন্স আর টি সার্টে অন্য এক চেহারায়!

দিনগুলো কেমন তরতরিয়ে কেটে গেলো ....."আশিতে আসিও না" কথাটাকে তুড়ি মেরে সিদ্ধেশ্বরবাবু এখন ছিয়াশির কোঠায়,শমিত আল্জাইমার রোগে আক্রান্ত...বেঁচে মরে আছে মানুষটা...সৌমিক তার পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়:

জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সিদ্ধেশ্বরবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন মেঘেরা সত্যি কত মুক্ত, নিজের মত করে ভাসে আকাশের গায়ে! সিদ্ধেশ্বরবাবু আসটে পৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছেন সংসার জালে......একাকিত্বের যন্ত্রণা কাটাতে মুক্তিও চাইতে পারেন না! সমিতা যে তাঁর চেয়েও অসহায়...... সৌমকদের ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে, ল্যাপটপ এর ছোট্ট স্ক্রীনে ছোট হতে হতে ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে ওরা
......... 

বড় একা লাগে - দেবদত্তা ব‍্যানার্জী

তিনমহলা বিশাল ভগ্নপ্রায় জীর্ণ বাড়িটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালের সাক্ষীর মতো। বড় সিংহ দরজার একদিক নেই।দরজার উপর দুটো সিংহর একটা ভেঙ্গে পড়েছে। লোহার দরজায় হাল্কা ধাক্কায় ক‍্যাঁচ করে আওয়াজ, নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ।আগাছার জঙ্গল পার করে একাই ঢোকে অপু। ডানা ভাঙ্গা পরীটা বহুদিন একা দাঁড়িয়ে বাগানের মাঝে, অবাক হয়ে তাকায় যেন। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোরা লনে বহুবছরের আগাছার জঙ্গল। বন্ধ দরজা জোড়ে চাপ দিতেই খুলে যায়। গোধুলীর কনে দেখা আলোয় অপু খুঁজে ফেরে নিজের শৈশব , কৈশরের স্মৃতীগুলো।
এক সময় দুর্গা পূজা হতো এই রায় বাড়িতে, আত্মীয় পরিজনে গমগম করত রায় বাড়ি। কাঠামোটা রয়ে গেছে ঠাকুর দালানে। কত বছর আলো জ্বলেনি। কেউ বাতি দেয়নি।


বংশের শেষ পুরুষ আজ দীর্ঘ তিরিশ বছর পর ফিরে এসেছে শিকড়ের টানে। আজ সে বড্ড একা, ঠিক এই অট্টালিকার মতো। একা একাই আধো অন্ধকারে স্মৃতীর গলিপথে ঘুরে ফেরে সে। একসময় আলোয় আলোয় সেজে উঠত এই প্রাসাদ। আজ পূর্ণিমার আলোয় ছাদের ভেঙ্গে পড়া কার্নিশে দাঁড়িয়ে অপু নদীর দিকে তাকায়। 
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জোয়ার আসছে। ভেসে আসে কত স্মৃতী। বংশের শেষ প্রদীপকে অনেক আশা নিয়ে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছিল দাদু। বিদেশিনীর প্রেমে মজে সবাইকে ভুলে ও দেশেই ঘর বেঁঁধেছিল সে। দাদুর শত অনুরোধেও ফেরেনি একদিন। মোহ কাটতে নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ একা পেয়েছিল। সেই একাকিত্বকেই সঙ্গী করে অবশেষে প্রত‍্যাবর্তণ। ইট বের করা দেওয়াল আর বন্ধ কপাটের ফাঁকে পরে রয়েছে কিছু সম্পর্কের দীর্ঘশ্বাস, একাকিত্বের গল্প।
চোখ বন্ধ করে অপু অনুভব করতে চায় অনেক কিছু। এদের মাঝেই কাটাবে নিজের শেষ দিন গুলো। বাতাসে ভেসে আসে একটা চেনা গন্ধ, একা থাকার গন্ধ।

যাত্রা - মুনমুন মুখার্জী রায়

-আমি এবার যাবোই তোমার সাথে। আমাদের বিয়ের এক বছর হতে আর মাত্র একটি সপ্তাহ বাকি। এই এক বছরে ক’টা দিন আমরা একসাথে কাটিয়েছি জানো? 

আলমারি থেকে কাঁচা হলুদের ওপর সেলফ ওয়ার্ক করা; সবুজ রঙের জরি বর্ডারের শাড়ীটি হাতে নিয়ে জানতে চায় বৃষ্টি। স্বাভাবিকভাবেই অপর পক্ষের কোন জবাব পাওয়া গেল না। নিজেই উত্তরটা দেয় তাই, 

-মাত্র একমাস সতের দিন। 

(মুহূর্তের নীরবতা) 
-তা’বলে ভেব না আমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। আমি জানি, একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তোমার দায়িত্ব কতটা! আমাদের বিয়েটা সম্বন্ধ করে হলেও বিয়ের আগে সব জেনে শুনেই রাজী হয়েছিলাম আমি। 

মিষ্টি মধুর স্মৃতি গুলো মনে হতেই বৃষ্টির ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির আভাষ... সেই হাসিতে মিশে ছিল অরিত্রের জন্য অশেষ ভালোবাসা। 
-বৌভাতের পনের দিন পর যখন তুমি জাহাজে ফিরে গেলে--- তারপর বুঝেছিলাম, আমিও ভালবাসতে শুরু করেছি; তোমাকে, তোমার সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষকে, তোমার ভালোমন্দ সবটুকুকে। 

খাটের দিকে সরে গিয়ে হাতের শাড়ী, ব্লাউজ আর ম্যাচিং জুয়েলারীগুলো একবার চেক করে নিল--- বিবাহবার্ষিকীতে পরার জন্য কিনলেও আজই পরবে বলে ঠিক করে সে। 
-ছুটিতে দু’বার এসেছ অবশ্য। কিন্তু তোমার সাহচর্য ঠিক সেভাবে কোথায় পেলাম বল? তুমি তো শুধু আমার স্বামীই নও, কারও সন্তান, কারও বন্ধু, কারও বা দাদা। সবারই আবদার আছে তোমার প্রতি। আমি সব বুঝি। তাই এবার আমি আর কিচ্ছু শুনবো না। 

খাটের ওপর রাখা অরিত্রের ছবিটাকে বুকের মাঝে কিছুক্ষণ চেপে রেখে বলে, 
-ভালবাসি আমি তোমায়, তুমি ছাড়া এসব কিছু অর্থহীন; একাকীত্বের অন্ধকারে নিমজ্জিত। 

ছবিটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে সাজগোজ শুরু করে বৃষ্টি।

পরদিন দুটি শবদেহের সৎকার হয়... একটি অরিত্রের; যে দুদিন আগে ডিউটি চলাকালীন উড়িষ্যা উপকূলের কাছাকাছি সমুদ্রে ওঠা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাহাজ থেকে রহস্যজনকভাবে সমুদ্রে পড়ে প্রাণ হারায়। অন্যটি ওর স্ত্রী বৃষ্টির; যে স্বেচ্ছায় ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...