মুখোমুখি দুজন বসে। সোমেন আর রিয়া।
ইশ, কি রোগা হয়ে গেছে! দাড়িটাও কামায় না আজকাল রোজ। ভাবে রিয়া।
সোমেন ভাবে, কোথায় গেলো আমার সাজুনি বৌটা, সবসময় যে টিপটপ থাকতো? এখন একটা এলোখোঁপা করেই বেরিয়ে পড়েছে, পরণে সাধারণ একটা সুতির ছাপা শাড়ি। অথচ একসময় এই রিয়াই বাইরে বেরনোর আগে নিজেকে একঘণ্টা ধরে সাজাতো, সোমেন অধৈর্য হয়ে পড়তো!
রিয়া ভাবে, মুখটা কি শুকনো লাগছে দেখো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে কি না কে জানে? বাবুকে তো হাতে প্লেট না ধরিয়ে দিলে খেতেই ভুলে যান। এখন তো একা একা, কি রান্না হচ্ছে, কি খাচ্ছে, কে আর খবর রাখে। রোজই মনে হয় দোকানের কিনে আনা খাবার চলছে। আর সিগারেট খেয়ে খেয়ে তো ঠোঁটটা কালো করে ফেলেছে। ভোরবেলা এত কাশতো, ডাক্তার সিগারেট ছেড়ে দিতে বলেছিলো। ছাড়া তো দূরের কথা, মনে হয় আরো বাড়িয়েছে।
সোমেন ভাবে, চেহারাটা কিরকম হাড়সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। ফাটা একটা স্লিপার পড়ে এসেছে। মা বাবা নেই, দাদার সংসারে বোধহয় খুব খাটাচ্ছে। টাকা দিতে চেয়েছিলাম মাসে মাসে, তিনি তো রিফিউজ করলেন। কি করে চালাচ্ছে কে জানে? করে তো ঐ দুহাজার টাকার সর্বশিক্ষার প্যারাটিচারি। কি সুন্দর লক্ষীপ্রতিমার মতো মুখটা ছিলো, এখন দেখো, মুখে কালি পরে গেছে।
রিয়া ভাবে, উফ, সোমেনটা এরকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? ওরকম তাকালে আমি হারিয়ে যাই, তুমি কি জানো না সোমেন? কি আছে আর আমার মুখে? বিয়ের পরে যখন রোজ ঝগড়া করতে, তখন তো আর তাকিয়েও দেখতে না। এখন তো আর রূপচর্চা করতেও ভালো লাগে না সোমেন। তুমি যখন ছিলে, তখন পৃথিবীটা কত বর্ণময় ছিলো, এখন কেমন যেন ধূসর হয়ে গেছে। আগে রোজ রাত্রে ঘুমনোর সময় ভাবতাম, কাল আবার একটা নতুন দিন আসছে, আর এখন ভাবি, কালকের দিনটা না আসলেই ভালো হয়।
আমি কি ঝগড়া শুরু করতাম, নাকি, তুমি করতে? ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শুরু হয়ে যেতো তোমার আমাকে বদলানোর প্রয়াস। ব্রাশটা জায়গামতো রাখোনি কেন? বাথরুমে সিগারেট খেয়েছো কেন? বাজার থেকে এইসব এনেছো, এগুলো এখন কুটে রান্না করবে কে? তোয়ালেটা চান করে কেচে দাও নি কেন? আবার তুমি আগের দিনের ঘেমো শার্টটা পরেই বেরচ্ছো? ফিরতে এত রাত হলো কেন? ঘেমো গায়ে আমার কাছে আসবে না, চান করে এসো- কত্ত কি অনুশাসন। পুরুষ মানুষকে অত বেঁধে রাখতে গেলে চলে না গো।
তুমি বুঝলে না সোমেন, তোমাকে আমি কত্ত ভালোবাসি। ভালোবাসি তাই চেয়েছি, তোমার কাছে কাছে থাকতে সবসময়। চেয়েছি, তুমি একটা সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ হয়ে ওঠো। আর তুমি, বিয়ের আগে আমায় কত সময় দিতে, একদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইলে মুখ ভার হতো, বিয়ের পরেই তুমি কত বদলে গেলে! সকালে বেরিয়ে গিয়ে রাত দশটা এগারোটার আগে বাড়ি ঢুকতে না। একা একা গোটা বিকেল সন্ধ্যেটা আমি কি ভাবে কাটাতাম, একবারও ভেবে দেখেছিলে কি?অফিস শেষ হয়ে যাবার পরে বাড়ি না ফিরে চলে যেতে বন্ধুদের আড্ডায়। তারপরে বাড়ি ফিরেই নিয়মমাফিক ডিনার করে যান্ত্রিক সঙ্গম। এতে মনেরও যে একটা ভূমিকা আছে তুমি কি বুঝতে না সোমেন? কি ভেবেছিলে? কাঁচপোকাটাকে তো হাতের মুঠোয় বন্দী করেই ফেলেছি, যতই ফড়ফড় করুক, উড়ে তো আর পালাবে না।
রিয়া, তোমায় তো আমি ভালোবাসি, এখনও। তুমি চলে যাবার পরেই বুঝতে পারলাম, তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি কি ফিরে যাবে, আবার, আমার কাছে? কোর্ট তো ডিভোর্সের আগে আমাদের একবছর সেপারেশনে থাকতে বলেছে, তিনমাস ছাড়া ছাড়া দেখা করতে বলেছে। চলে যাবার তিনমাস পরে এই প্রথম তোমার সাথে দেখা হলো। কোর্ট চায়, আমরা মিটিয়ে নিই। আমি যা ভুল করেছি, সেগুলো আর করবো না রিয়া। তোমার ভালোবাসার শাসনগুলো মেনে নেবো। তোমায় মিস করছি সোনা, খুব।
আমিও তো তোমায় মিস করছি, সোনা, ভীষণ। কিন্তু তুমি না ডাকলে আমি কি করে ফিরে যাই বলো। তুমি একবার ভালোবেসে ডাকলেই আমি ছুট্টে চলে যাবো গো। তোমার কাছে।
মুখোমুখি বসে থাকে দুই অসুখী মানুষ। মাঝে কফি শপের টেবিলে ফড়ফড় করে উড়তে থাকে তামাদি হয়ে যাওয়া কিছু ম্যাগাজিনের পাতা। নিয়মমাফিক একবছরের সেপারেশনের সময়ে তাদের চারবার দেখা করে মিটমাট করার প্রয়াস চালাতে হবে। অনেক কথা আছে তাদের মধ্যে, সে শুধু মাঝের এই তিনমাস সময়ই জানে। কিন্তু অটল নৈঃশব্দ্যের মাঝে তারা মাথা উঁচু করে বসে থাকে। কে আগে নত হবে, এই চিন্তা তাদের কুরে কুরে খেতে থাকে। কথা আর তাদের বলা হয় না।
অথচ, কথা ছিলো, ঢের কথা ছিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন