আমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সেই দিনটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারবো না । সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ গুজরাটের বরোদা শহরকে আলবিদা জানিয়ে চেপে বসেছিলাম আমেদাবাদ – হাওড়া এক্সপ্রেসে । আলবিদা জানিয়ে এসেছিলাম সেই জার্মান বহুজাতিক সংস্থাকে যেখানে কাটিয়ে এসেছি চাকুরী জীবনের প্রথম দশটা বছর । মনেমনে প্রস্তুত হয়েছিলাম টাটাস্টীলের একটি ডিভিশনে নতুন চাকরীতে যোগ দেবার জন্য । আমাকে ট্রেনে চাপিয়ে দিতে এসেছিলেন আমারই কিছু বন্ধু যাদের চিরকালের জন্য ছেড়ে এসেছি বরোদায় । একজন পোড় খাওয়া বন্ধু বারবার সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন - ‘ রাত্রে সজাগ থেকো সুধাংশু । নাগপুরের ওদিকে চোরের খুব উপদ্রপ কিন্তু । কখন তোমার মালপত্র নিয়ে চম্পট দেবে টেরও পাবে না ।’
যাই হোক দিনটা ভালোই কাটলো চলন্ত ট্রেনের জানালার ধারে বসে নতুন চাকরী , নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন করে বসত গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে । হায় রে , তখন কি জানতাম কপালে কী লেখা রয়েছে ! সেই রাতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজের রিজার্ভ করা সীটের ওপর । ঠিক ঘুমোনো নয় , সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম । মাঝরাতে কোন একটা স্টেশন থেকে কিছু যাত্রী এসে উঠেছিলো সেই কামরায় । একজন পেছন ঠেকিয়ে বসেওছিলো আমার মাথার ধারে । আমল দিইনি । এমনটা ঘটেই থাকে দূরপাল্লার ট্রেন সফরকালে । হঠাৎ মিষ্টি একটা গন্ধ এসে লাগলো আমার নাকে । তারপর আর কিছু মনে নেই । একেবারে তলিয়ে গিয়েছিলাম গাঢ় ঘুমে । সেই ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে । উঠে বসে টুথপেষ্ট এবং টুথব্রাশ নিতে যেতে টের পেলাম আমার কপাল পুড়েছে । পোড় খাওয়া বন্ধুটির কথা মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে । চোর এসে আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে !
ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার জন্য টুথপেষ্ট এবং টুথব্রাশ নিতে গিয়ে দেখি সীটের তলায় চেন দিয়ে বেঁধে রাখা আমার তলপিতলপা লোপাট হয়ে গিয়েছে । ঝোলা ব্যাগটা খোয়া যায়নি বালিশ করে শুয়েছিলাম বলে । আর চুরি হয়নি বহুব্যবহৃত চপ্পল জোড়া । স্টীলের চেনে বাঁধা দুটো সুটকেসে ছিলো আমার সর্বস্ব বস্তু । একটায় ছিলো টাটাস্টীলের দেওয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার , স্কুল কলেজের যাবতীয় অরিজিনাল সার্টিফিকেট , ছেড়ে আসা জার্মান কোম্পানির শংসাপত্র , নতুন কেনা তিনপ্রস্ত জামাকাপড় ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক বস্তু আমার কাছে যার মূল্য অসীম । সবই উধাও হয়ে গেল সুটকেস সমেত । অন্য সুটকেসটায় ছিলো মা-বাবার জন্য , ছোটোভাইবোনদের জন্য কিনে আনা বেশ কিছু উপহার সামগ্রী ।
দেখে মাথায় আকাশ যেন ভেঙে পড়লো । গতদিনও ছিলাম চাকুরীজীবী অথচ এক রাতেই নাম লিখিয়ে ফেলতে হলো বেকারদের তালিকায় । নতুন অফিসে গেলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছাড়া কেই বা শুনবে আমার কথা ? কোনো প্রমাণই যে নেই আমার সঙ্গে যা দিয়ে নিজেকে সেই মানুষটি বলে পেশ করবো ওদের সামনে ?
সহযাত্রীদের অনেকেরই মালপত্র চুরি হয়েছে সেই রাত্রে । সকলেই হাহুতাস করছেন এবং আমি ভাসছি চোখের জলে । বাড়িতে ঢুকে মা-বাবাকে কি বলবো সেই ভাবনা কুরেকুরে খেতে থাকলো আমাকে । নাগপুর স্টেশন এলো ঘণ্টা দেড়েক পর । ঐ স্টেশনে নেমে আর পি এফ –এর অফিসে গিয়ে এফ আই আর করলাম । এছাড়া আর কীই বা করার ছিলো আমার ?
সেদিনের অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর , ১৯৮৬ -এর কথাটা মনে পড়লে আজও আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে । ঈশ্বরের কৃপায় নতুন চাকরীতে যোগ দিতে পেরেছি । সেখান থেকে অবসরও নিয়েছি একদিন । তবুও সেদিনের সেই আতঙ্ক আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে । যখন বেকার ছিলাম তখন যতটা না ভুগতাম সেদিন নতুন কোম্পানী থেকে পাওয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চুরি হয়ে যাবার পর তারচেয়ে শতগুণ বেশী ভুগেছিলাম বেকারত্বের জ্বালায় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন