শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

স্মৃতির অ্যালবাম থেকে ----- মুনমুন মুখার্জী




সময় বহতা নদীর মতই গতিমান... বিরামহীন বয়ে চলে একই দিশায় ... অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে। তারই মাঝে যাপিত জীবনের কিছু বিশেষ মুহূর্ত হৃদয় লিপিতে নথিভুক্ত হয়ে রয় আপন মহিমায়... বিশেষিত হয় “বিশেষ দিন” হিসেবে। কালক্রমে স্ট্যাটিক হৃদয় লিপিতে নিবদ্ধ হয় ততোধিক “বিশেষ দিন” পঞ্জী। এভাবেই আজকের বিশেষ দিনটি কাল গুরুত্ব হারায়, কালের গতিতে নিপতিত হয় অতীত গহ্বরে। তবুও কিছু অতীত মুহূর্ত বর্তমান পেরিয়ে ভবিষ্যতের ভ্রূকূটি অগ্রাহ্য করেও স্ব-মহিমায় নিজের অস্ত্বিত্ব বজায় রাখে। বারবার স্মৃতির সিন্দুক খুলে সেসব মুহূর্তের ভাঁজে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দকেই বুঝি বলে “নস্ট্যালজিয়া।”
“আমার জীবনের সেই বিশেষ দিন” বলতেই অনেকগুলো স্মৃতি সিন্দুক খুলে হুড়মুড়িয়ে একসাথে বেরিয়ে এল। কেউ বলে, “আমায় নিয়ে লেখ,” কেউ বলে, “ওর চেয়ে আমার স্মৃ্তি অত্যোধিক আকর্ষণীয়... সেই বিশেষ দিনের খেতাব আমারই প্রাপ্য।” এই লড়াই এর মাঝে একটি পেলব স্মৃতিকে বেছে নিতে গিয়ে অনুভব করলাম, আমার অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যেও নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এই প্রাপ্তি তো একদিনের কিছু অভাবনীয় মুহূর্ত নয়! এ তো অনেকদিনের সমষ্টিগত কিছু মুহূর্তের উপসংহার মাত্র!
ভূমিকা ছেড়ে সেই ছেঁড়া-ছেঁড়া মুহূর্তগুলো জুড়ে নিয়ে “সেই বিশেষ দিন”টিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করি এবার –
আমরা যখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে হাঁটছি তখন দু’টি মাত্র রেকগনাইজ্ড লক্ষ্যই ছিল সায়েন্স নিতে হবে তারপর হয় ডাক্তার নয় তো ইঞ্জিনিয়র হতে হবে। ব্যতিক্রম ছিলাম না আমি বা আমার পরিবার। তবে পুরো পরিবার প্রাণপন চেয়েছিল আমি মেডিকেল কলেজে পড়ি। আমি চেয়েছিলাম আর্কিটেকচারে পড়ব। যে মেয়েটি রক্ত দেখে আজও সেন্সলেস হয়ে যায় সে কিভাবে মেডিকেলে পড়বে সেটা কেঊ ধর্তব্যের মধ্যেই আনলো না! এমনকি যে মানুষটি আমাকে সবচেয়ে ভাল বোঝেন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাবাও ভাবলেন না একবার! খুব অভিমান হয়েছিল। কিন্তু মনে মনে চাইছিলাম, কিছু একটা ঘটুক! সব পাল্টে যাক। গিয়েছিল সব পাল্টে। আমার আর এক কাছের মানুষ “দাদু” সেদিনই আমাদের জীবন থেকে নেই হয়ে গেলেন।
এমন কিছু চেয়েছিলাম কি আমি?
বাবা শুনে শুধু বললেন, “তুমি যা চাও সেটা আমায় আগে জানাও নি কেন? তাহলে মেডিকেলের কোচিং না করিয়ে আর্কিটেকচারে করতে!” বাবার কাছেই পেলাম জীবনের এক প্রয়োজনীয় শিক্ষা। “Once you feel something is not meant for you, raise your voice up. Otherwise you will be the looser, none can read your mind actually.”
তখন আর সময় নেই নেক্সট ইয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু এক বছর অলস বসে থাকব? বাবারই পরামর্শে BBA তে চেষ্টা করলাম। পেয়েও গেলাম। পরিযায়ী পাখির মত সময় কাটালেও প্রচুর বন্ধু পেলাম। পরের বছর জুনিয়রদের সাথে মেডিকেলে পড়তে ইচ্ছে হল না। বাবাই সলিউশন দিলেন। “ব্যাঙ্গালোরে পড়াশোনা কর।” ভিসা, পাসপোর্ট সব রেডী। পছন্দের বিষয়, কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়রিং-এ। বন্ধুরা বাবাকে বোঝাল, আমি না কী সবাইকে ছেড়ে থাকতেই পারব না। বাবা বুঝলেন, আমি বুঝলাম না। বাবার শোনালেন দ্বিতীয় জীবন দর্শন, “জীবনে প্রকৃ্ত বন্ধু পাওয়া অসম্ভব। পেলে তাদের হারাতে নেই।” এর চেয়েও জরুরী যা শিখলাম, ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়র হওয়ার ইঁদুর দৌঁড় জীবনের একমাত্র লক্ষ হতে পারে না নতুন সাবজেক্ট বিবিএ... কমার্স তো কী হল? চ্যালেঞ্জ নেয়ার বা অসম্ভব সম্ভব করার মধ্যে যে থ্রিল সেটা গতানুগতিকতায় নেই।
বিবিএ ফাইনালের আগে সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সবার সাথে একটা ডিসটেন্স তৈরী হচ্ছিল। মা কে বললাম, “আমিও বিয়ে করব।” মেয়ের সুমতিতে মা বেজায় খুশী। এক সপ্তাহের মধ্যে মায়ের বন্ধুর ছেলের সাথে কথা পাকা। দু পরিবার বেজায় খুশ। বাবা বললেন, “ছেলে মেয়ে পরস্পরের সাথে একবার বসবে। এর বাইরে অন্য কেউ মেয়েকে বার বার দেখতে আসতে পারবে না। আমার মেয়ে মাছ বাজারের মাছ নয়!”
সেই মত দিনও ঠিক। এক ছুটির দিনে “অফিসিয়াল ডেটিং” ফিক্সড। আগের রাতে বাবা মাথায় হাত রেখে বললেন, “সারা রাত আছে, তুমি সত্যি বিয়ের জন্য রেডী? পারিবারিক বন্ধুত্ব, পাকা কথা, মা-বাবার সম্মান এগুলো ঠুনকো অহমিকা মাত্র। এসব আমার মেয়ের ইচ্ছের চেয়ে ইম্পর্টেন্ট নয়।” সারা রাত ভেবে মনে হল, “কে এ? কাকে বিয়ে করব? কেন? এ নয় অন্য কেউ!”
সকালে বাবাকে বললাম, “আমি যেতে চাই না!” কারণ না জেনেই বাবা ফোন করে ক্যান্সেল করে দিলেন। কয়েক মাস পর যেদিন বাবা জানলেন, আমারও কাউকে ভাল লেগেছে, মন থেকে মানতে পারলেন না। তবুও বাঁধা দিলেন না। বললেন, “আমার মেয়ে কখনও ভুল করতে পারে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস!”
বাবার সাথে এখন শুধু ফোনে কথা হয়। সেদিন বললেন, “তোমায় নিয়ে আমি ভাবি না। কারণ আমি জানি, প্রয়োজনে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে তীরে ফিরতে তুমি জান!” এতটা বিশ্বাস, এত ভরসা আর কে করে আমায়? নিজের উপর এতটা বিশ্বাস আমার নিজের আছে?


চোখ দুটো ভালবাসা আর আত্মবিশ্বাসে বার বার আর্দ্র হয়ে উঠছিল সেদিন... সেই বিশেষ দিনে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...