শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

প্রতীক্ষায় ---- দেবদত্তা ব্যানার্জী

কিশোরী বয়সে 'শাপমোচন' আমায় বুঝিয়েছিল ভালবাসা কারে কয়। সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছিল আমার কাছে। ছোটবেলায় পড়া রূপকথা 'ব্যাঙ রাজকুমারের' গল্প ভেসে উঠেছিল মানস পটে। নিজেকে কমলিকা র মত স্বর্গ ভ্রষ্টা নারী মনে করতাম।কমলিকার মত আমিও দিবস রজনী কারো আসায় অপেক্ষা বুকে নিয়ে দিন গুনতাম। অসুন্দরের ভিতর সুন্দরকে খুঁজে ফিরেছি প্রতিনিয়ত। যা সত্যি সুন্দর তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করি নি কখনো। অরুনেশ্বরের সন্ধানে পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছি, কমলিকা ছিল আমার মন প্রাণ জুড়ে। কিন্তু বসন্ত এত সহজে ধরা দেয় নি। আমার বিনিদ্র রজনী কেটেছে তার অপেক্ষায়। নিজের ভালবাসা দিয়ে কাউকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারি নি। আমার শাপ মোচন হয় নি .......

যৌবনের প্রারম্ভে এসে প্রেমে পড়েছিলাম অর্জুনের। আমি যেন সত্যিই চিত্রাঙ্গদা। মা এর ছিল ছেলের শখ। একমাত্র মেয়েকে ছেলেদের পোশাকেই সাজাতো বেশি। চুল ও ছোট করে কাটা। র‍্যাগিংএ একটা লাল শাড়ি ও টিপ পরে ও যখন  হাঁটতে বলেছিল রাগ হয়েছিল। কিন্তু যেদিন কলেজের নবীন বরনের অনুষ্ঠানে প্রথম চিত্রাঙ্গদা দেখেছিলাম বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে নিজের প্রতিচ্ছবিকে প্রশ্ন করেছিলাম "কেন?"
আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিলাম অর্জুনের প্রেমে। নারী হয়ে উঠেছিলাম ওর জন্য। ছোট্ট টিপ, হাল্কা লিপস্টিক, মা এর ধূপছায়া রঙ এর ঢাকাই এ নিজেকে সাজিয়েছিলাম। অবাধ্য বয় কাট চুলে টারসেল দিয়ে বেঁধেছিলাম জুঁইয়ের মালা। আমার অর্জুনের জন্য আমি তখন সব পারি। আমার চোখে সে কোন আলো লেগেছিল জানি না, রাতারাতি আমূলে বদলে গেছিলাম। অর্জুন কে পাওয়ার জন্য চিত্রাঙ্গদা তখন পাগল। আর আমার পাগলামি দেখে নতুন সহপাঠীরা হতভাগ। কিন্তু হায় রে মন......

যার জন্য আমার মধ্যে এত পরিবর্তন সে চোখ তুলে দেখে নি। অবজ্ঞায় দুরে ঠেলে দিয়েছিল আমার ভালবাসা। আমার এই ভাবনা গুলোর কোনো দাম দেয় নি আমার কৃষ্ণসখা।

এ অপমান লেগেছিল আমার হৃদয়ে। সহ্য করতে সময় লেগেছিল। আস্তে আস্তে বদলে ফেলেছিলাম নিজেকে আবার। শিখেছিলাম ফ্লাট করতে, চটুলতা আর বাকচাতুর্যে জয় করতে শিখেছিলাম পুরুষ হৃদয়। পর মুহূর্তে ই পদদলিত করে নিতাম আমার প্রতিশোধ। হ্যাঁ, শ্যামার মতই হৃদয় হীনা নারীতে বদলে গেছিলাম। শ্যামার মতই পুরুষদের নিয়ে খেলা আমার লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। কত পুরুষকে যে আমার মোহজালে বেঁধে তাদের হৃদয় নিয়ে খেলেছি মনে নেই। 
আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। বাংলা অনার্সের শান্ত ছেলেটা শুধু চুপ করে আমায় দেখত। মুখ ফুটে না বললেও ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারতাম। তরুণ কিশোরের স্বপ্নিল দু চোখে আমি সেই ভালবাসা দেখেছিলাম। কিন্তু আমি যে তখন শ্যামা, বজ্র-সেনের জন্য ঐ সদ্য যুবকের ভালবাসাকে অপমান করে ছুটে গেছি আরও ওপরে। আমার কল্পনার বজ্র-সেনের খোঁজে আমি শ্যামা হয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছি প্রতীক্ষায়......

না, আমি কমলিকা হয়ে পৃথিবীর সব কুৎসিত কে, সব অসুন্দর কে সুন্দর করতে পারি নি। পারি নি চিত্রাঙ্গদা হয়ে অর্জুনের ভালবাসা পেয়ে নিজেকে ধন্য করতে, আজ আমি শ্যামার মত ছলনাময়ী, প্রতীক্ষায় আছি কোন এক বজ্র-সেনের......

1 টি মন্তব্য:

  1. এই লেখাটিতে প্রেমিকা নারীর প্রেমের সন্ধানে যে রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে তা চিরন্তন । শুধু প্রেম কেন কোনও মানবীয় অনুভুতি আগে থেকে স্থির করে দেওয়া মাপকাঠির মধ্যে রেখে দিলে হয়তো চিরটা কাল অপেক্ষার মধ্যেই থাকতে হয় আর উপেক্ষার মধ্যে থেকে যায় সেই নিকষিত হেম যা মনের বহির্দ্বারে থেকে বরন করে নেয় আত্ম-হনন, মধুর মরনে সে তার প্রাণ সঁপে দেয় । দেবদত্তার লেখার মধ্যে প্রেমের অনুসন্ধানে এই চিরন্তন সত্য সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ।

    উত্তরমুছুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...