শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

সাহিত্যের সেকাল ও একাল --- অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য

গণিত শাস্ত্রে জ্যামিতি একটা গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। জ্যামিতি মূলত দু প্রকার। যেটা আমরা মাধ্যমিকের আগে পড়ি সেটাকে বলে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি। ইউক্লিড্ কিছু সিদ্ধান্ত কে বিনা প্রমান মেনে নিয়েছেন। যেগুলোকে বলে স্বতঃসিদ্ধ। আর কিছু সূত্র প্রমান করেছেন ওই স্বতঃসিদ্ধ ধরে। যেগুলো কে বলাহয় উপপাদ্য। আর এই উপপাদ্য আর স্বতঃসিদ্ধ দিয়ে যা প্রমান করতে হয় সেগুলোকে চলতি কোথায় বলাহয় এক্সট্রা। সাহিত্য আর সমাজের সম্পর্ক অনেকটা এই উপপাদ্যের মতো। সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। এটা যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে যুক্তি দিয়ে প্রমানও করা যায় যে সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। অনেকটা ওই উপপাদ্য প্রমানের মতো। খুব সংক্ষেপে প্রমান টা হলো - সাহিত্যের তাৎপর্য আর সমাজের সংজ্ঞা - এই দুই সমীকরণের সমাধান। সাহিত্যের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে রস নিস্পত্তির মধ্যে। রস হলো একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রোডাক্ট। যেখানে বাইরের সমাজ আর মনের ভাব এই দুই উপাদান বিক্রিয়া করে রস সৃষ্টি করে। সমাজের আলম্বন হলো বিক্রিয়ার অনুঘটক। তাই শুরুতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। বিষয়টা অনেকটা বিজ্ঞানের মতোই যুক্তিগ্রাহ্য। 
মোবাইল টেকনোলজি সমাজে রেভোল্যুশন এনেছে দুহাজার সালের পর থেকে। দুহাজার সালের পর, বিশেষ করে যেদিন থেকে ফেইসবুক এসেছে, সেদিন থেকে - মানুষের কাছে পৌঁছনোটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অনেকেই কবিতা লেখে, অনেকেই গল্প লেখে আবার আমার মতো কেউ কেউ হিজিবিজি লেখে। আগে অনেকেই এই লেখা গুলো বইয়ের পাতায় বন্দী করে রাখতো। আজ ফেসবুকে ভাষা উম্মুক্ত। নানান রং র ছবির কোলাজের মাঝে লেখার প্রেসেন্টেশন। অনেকেই লেখে। সবার লেখা মনে দাগ না কাটলেও কেউ কেউ বেশ ভালোই লেখে। অনেকেই পড়ে। লাইক, রিমার্ক কতকিছু। ঝা চকচকে প্রেসেন্টেশন। শুধু একটাই প্রশ্ন থাকে লেখাগুলো মনে কতক্ষন স্থায়ী হয় ? আবার একটা নতুন পোস্ট, নতুন মুড্। 
যদি সময়টা একটু পিছিয়ে যাই, মানে দুহাজার সালের আগে, তখন কেমন ছিল সাহিত্য ! কিছু সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা। অথবা বই লেখা। প্রেসেন্টেশন মানে বইমেলা। এরই মধ্যে লেখককে পৌঁছতে হবে পাঠকের মনে। আর সেটা না হতে পারলে সব চেষ্টাই মাটি। লেখকের দায়িত্ব পাঠক কে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া। মানে বই কিনতে বাধ্য করানো । সেটা ভালোলাগার টানে, ভালোবাসার টানে। সেদিন সমাজ আমাদের দিয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টপাধ্যায় এনাদের মতো সাহিত্যিক। যাদের লেখা বার বার পড়েছি। বই কিনে পড়েছি। পূজাবার্ষিকী খুলেই আগে এনাদের লেখা পড়েছি। এমনকি পান্ডব গোয়েন্দা বা কিকিরা এইসব চরিত্র মনে দাগ কেটে গেছে। কবিতার কথা বললে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এনারা আজকের দিনেও প্রাণবন্ত। কি ছিল তাদের লেখাতে ? খুব সহজ কোথায় বললে ওনাদের লেখা মনে দাগ কেটে যেত। একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যেত না। খাবার টেবিলে, রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে, বা টেক্সট বই এর মধ্যে লুকিয়ে। বাবা মার বকুনি, স্যারের মার সব কিছু উপেক্ষা করে পড়েছি। ভুল বললুম। লেখাগুলো পড়িয়ে নিয়েছে। আমরা পড়িনি। আমাদের পড়িয়ে নিয়েছে। বয়সের সাথে সাথে সমাজের পরিবর্তন যেন মনের কোনে উঠে এসেছে, আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছে গুলো ডানা মেলে উড়ে গেছে। রস নিস্পত্তি। ভাব আর বাইরের জগৎ বিক্রিয়া করে যে রস উৎপন্ন করেছে সেটা মনের সাথে মিশে গেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় দ্রবীভুত হয়। 
আর একটু পিছিয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের যুগে। ছোটগল্প নিরুপমা। বিষয় পণপ্রথা। এবার বিশ হাজার পন আর হাতে হাতে আদায়। সামান্য একটা লাইন। একশো বছর পরও যার তাৎপর্য প্রাসঙ্গিক। মনের কোনায় যে রস ছড়িয়ে দেয়', সেটা জানায় - বেদনার কি ভাষা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহেশ। আজকেও পড়লে চোখে জল আসে। দেবদাস। একটাই প্রশ্ন জাগায় - ভালোবাসা করে কয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর পদ্মানদীর মাঝি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এনারা কালজয়ী। কারণ একটাই। এনাদের লেখা সমাজের বাস্তবের সাথে মনের যন্ত্রণার সংযোগ ঘঠায়। কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন। লেখা পড়তে হয় না। লেখক পড়িয়ে নেন। একবার নয় বার বার। আর বারবার আসে নব অনুভূতির সজীবত্ব। 
আজ আমরা বাচ্চাদের বলি মোবাইল এডিক্ট। আমরা নিজেরাও এডিক্ট। আজকে ছোট বড়ো সবারই মন অস্থায়ী। টি ভি তে সিরিয়েল দেখলে দেখা যাবে একজন মহিলা আদা জল খেয়ে পেছনে পড়ে আছে আর এক মহিলার ক্ষতি করতে, আর অন্যদিকে ছেলে মানেই নারী বিদ্বেষী নাহলে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির । আমরাও গোগ্রাসে গিলছি সেই সিরিয়াল। আমাদের মনের আবেগ গুলো আজ ভীষণ জটিল সমীকরণের মাঝে সমাধান খুঁজে পায়না। আর তাই ঘুরতে থাকে ঘূর্ণাবর্তে। যিনি লিখছেন তিনি নিজেই কনফিউসড। নিজের কাছেই পরিষ্কার নন কি ঠিক আর কি ভুল। শুধু কিছু আবেগকে ভাষায় পরিণতি দেয়া। দোষ আমাদের। আজকে লেখক লেখা পড়াতে চান। পড়িয়ে নিতে পারে কি ? সমাজের প্রতিফিলন সাহিত্যে আসে কি ? ঘটনার প্রতিফলন আসে। ব্যঞ্জনা জাগে না। লেখা সুন্দর লেখার হাত সুন্দর। হাতের লেখা সুন্দর। শুধু অভাব রাসায়নিক বিক্রিয়ার। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিসলেই কি জল হয় ? বাতাসে অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন আছে। তবু বিক্রিয়ার জন্য চাই বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুতের ঝলক কোথায়। শুধু শব্দের গুড়গুড় রব । অনেকে আছে হিউমান সাইকোলজি হিসেব করে লেখেন। সুন্দর লেখা। শুধু বিভাব আর অনুভাবের সংযোগের বড়ো অভাব। তাই রস আর নিস্পত্তি হয় না। লেখা হারিয়ে যায় বইয়ের পাতায় বা থেমে থাকে ফেসবুকের ওয়াল এ। অন্ধকার আসে শরীরের মিলন হয়। শুধু মুখোমুখি বসার জন্য বনলতা সেন আর নেই। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...