মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

ল্যাম্পপোস্ট -- চন্দ্রিমা গুপ্ত

বর্ধমান থেকে বেশ খানিকটা দূরে মফস্বলের ছেলে আনন্দ প্রসন্ন. বাবার মুদির দোকান, ওকে নিয়ে চার চারটে ভাইবোন অর্থাৎ ছয় জনের সংসার. গরীবের ঘরেই পুষ্য়ির সংখ্যা বেশী এতো এদেশের পরম্পরা. যাক, বাবার মুদির দোকানের রোজগারে পেট ভরে দুবেলা ডালভাতের জোগাড় হয়ে যায় কোনোক্রমে. এখানেই ধুঁকে ধুঁকে চলা স্কুলেই চার ভাইবোনের পড়াশুনা. আনন্দ প্রসন্ন বড়, ছোট ভাই শুভ্র প্রসন্ন দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আর বোন দুজন অবৈতনিক সীমার মধ্যেই অর্থাৎ একজন অষ্টম, একজন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী:
পড়াশুনায় আনন্দ প্রসন্ন সব সময় নজরকাড়া সফলতা নিয়ে এগিয়েছে. স্নাতকও শেষ করেছে মফস্বলের কলেজেই, কিন্তু এরপর মফস্বলে সেরকম আর সুযোগ নেই তাই শহরই একমাত্র ভরসা, না হলে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কোনো স্বনির্ভার ব্যবসায় নেমে পরা. অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তর করার ইচ্ছা আনন্দ প্রসন্নের. বাবা-মায়েরও বিপুল উত্সাহ কিন্তু বাধা একটাই --- অর্থাভাব:
ইচ্ছা আন্তরিক হলে আর সংকল্পে দৃঢ়তা থাকলে বোধহয় পরমেশ্বরের করুণা পাওয়া যায়, আর তাই-ই বোধহয় বিকাশ স্যার ওকে শহরে সরকারী স্কুলে চাকুরীরত এক বন্ধুর ঠিকানা দিলেন, থাকার জন্যে একটা ব্যবস্থা যাতে হয়ে যায় আর যদি কিছু টিউশনের ব্যবস্থা হয়. দুবার ভাবার অবকাশ নেই: আনন্দ প্রসন্ন বিকাশ স্যারের দেওয়া ঠিকানা, বাবার দেওয়া অল্পবিস্তর টাকা সম্বল করে বেরিয়ে পরল শহরের উদ্দ্যেশ্যে: শুরু তো করা যাক, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্যের দিকে, কে বলতে পারে "কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে" প্রবাদ বাক্যটা আনন্দ প্রসন্নের জীবনে সত্যিও তো হতে পারে!
শহরে পা রেখেই বুদ্ধিমান আনন্দ প্রসন্ন বুঝতে পারল চোখ-কান সজাগ না রাখলে পাঁকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া, বোকা বোনে যাওয়ার অনেক রকম ফাঁদ আর প্রলোভন মাকড়সার জালের মতোই বিস্তার করে আছে শহরে, সত্ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইটা বেশ কঠিন: বিকাশ স্যারের বন্ধুর বদান্যতায় অল্প টাকায় একটা থাকার জায়গা আর কয়েকটা টিউশনের হদিশ পাওয়া গেল: ব্যস এবার পথ চলা শুরু ....কিন্তু একমাসের মধ্যেই আনন্দ প্রসন্ন উপলব্ধি করলো বাবা-মায়ের ভালোবেসে দেওয়া নামটাই তার নিরানন্দের কারণ. নামটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা আর বিদ্রূপ করে প্রায় কোনঠাসা করে ফেলল ওকে, ওই-ই এখন ওদের অর্থাৎ গেস্ট হাউসে বসবাসকারী বঙ্গ সন্তানদের আড্ডার অন্যতম রসদ. চোখ-কান বুজে সহ্য করতে লাগলো আনন্দ প্রসন্ন, এছাড়া আর উপায়ই বা কি! তবে ভাবেনি এই বঙ্গ সন্তানেরা রীতিমত মদ-পিপাসু. এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না বলে আনন্দ প্রসন্নকে জোড়াজুরি করা শুরু হল. বড় অসহায় লাগে ওর, শহরে প্রথম পা রাখা, অচেনা তো বটেই তবে এতোটা!! কে কোথা এসেছে? কি করে? জানারই সুযোগ পায়নি আনন্দ প্রসন্ন, সহযোগিতা বা বন্ধুত্ব তো দুরঅস্ত. শেষ পর্যন্ত ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাবে! বিজন, কমলেশ, দ্বৈরথদের মতো ষ্টেশনারী দোকান, পোল্ট্রি অথবা ভাতের হোটেল বা ছোটখাটো অন্য কোনো ব্যবসা শুরু করবে? ভুলে যাবে নিজের লক্ষ্য, হার স্বীকার করে নেবে?
আজ টিউশনি থেকে ফিরে গেস্ট হাউসে ঢুকতে ভয় করছে ওর, আবার সেই মদ্যপায়ীদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হওয়া......, গেস্ট হাউসের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ল্যাম্পপোষ্ট, শহরের আলোর রোশনাইয়ের একটা সংযোগস্থল: যন্ত্রনাটা যেন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আনন্দ প্রসন্ন আর ভাবতে পারছে না. মনের জোরটা কে যেন লুট করে নিচ্ছে. শির-দাঁড়াটা যেন দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিতে চাইছে কোনো অশুভ শক্তি:
ল্যাম্পপোষ্টটাকেই আঁকড়ে ধরে অস্ফুটে বলে উঠলো আনন্দ প্রসন্ন, "মা-আআআ, মাগো-ওওও". হঠাৎ কাঁধের উপর একটা হালকা স্পর্শের অনুভুতি, দৃঢ় কন্ঠস্বরে প্রকৃত বন্ধুত্বের আশ্বাস: নিস্প্রভ দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো আনন্দ প্রসন্ন, দ্বীপান! ওকে তো দেখাই যায় না, প্রায়ই রাতে ফেরে না, মাঝে-মাঝে সবাইকে ক্যাডবেরী খাওয়ায়, উদ্বাস্ত্ব কন্ঠে গান গায়, মদো গন্ধটা তখন ভ্যাপসা দুর্গন্ধ হয়ে নি:শ্বাস ভারী করে না, কিন্তু ওর সম্পর্কেও কিছু জানে না আনন্দ প্রসন্ন; "আরে আনন্দ তুই?" - খোলা গলায় ডাকলো দ্বিপান,"আয় আমার সঙ্গে আয়. প্রথম প্রথম আমারও এমন হয়েছিলো, এখন ঐ ল্যাম্পপোষ্টের চেয়েও শক্ত আর মজবুত মন করে ফেলেছি, তুইও পারবি দেখিস,একটু কষ্ট হবে এই যা, আমার হাতটা ধর চল এগোই".

Show more reacti

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...