শনিবার, ৫ মার্চ, ২০১৬

জামার পকেটে কিছু পোলাও এবং ভাঁজের ভেতর চোরকাঁটা ~ লুতফুল হোসেন

শাড়ীকে আমি বলি খুব উত্তেজক পোষাক । আপনি একমত হবেন কি হবেন না তা একান্ত আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার সাধীনতা । তার, আপনার, উনার, সবার এতে সহমত কিংবা দ্বিমত যা ই হোক । আমার দৃষ্টিতে শ্যালোয়ার-কামিজ শাড়ীর চেয়ে অনেক শালীন পোষাক । পুরোটা শরীর অনেক ভালো মতোন ঢেকে থাকে এতে শাড়ীর চেয়ে । আপনি হয়তো এবার আনতে পারেন ওড়নার প্রসংগ । ওটা থাকলো কি থাকলো না । থাকলে কোথায় কি ঢং-এ থাকলো ।
ধরুন শার্ট-প্যান্ট এর কথাই । পুরোটা শরীর ঢাকে না এতে ভালো ? শাড়ীর চেয়ে ঢের ভালো ঢেকে থাকে বলেইতো মনে হয় । তাই না ! শাড়ীতে যদি শরীরের বিশ থেকে পঁয়ত্রিশ শতাংশ অংশ কেবল সাদামাটা নয় সংবেদনশীল দৃষ্টিগোচরতায় উদার থাকে । শার্টে কিন্তু সে তুলনায় পাঁচ ভাগও উন্মুক্ততায় উদার থাকে না ।
এবার হয়তো বলবেন মুম্বাই ফিল্মী কায়দায় যা সব কাট আর কেতা শ্যালোয়ার-কামিজে দেখা যায় আজকাল ! তাছাড়া শার্টের কোথায় কয়টা প্লিট-স্লিট, প্যান্ট কি পরিমান আঁটোসাটো ! শালীনতাকে আপনি কিছুতেই তর্কের ছুরির নীচ থেকে সরতে দেবেন না । তর্ক করলে সেটা নির্ঘাত চলতেই থাকবে । আসল কথাটা তাহলে কি ? যে কথায় এসে থামতে পারে এই তর্ক-বিতর্ক !
আমি যে শাড়ী নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলাম । উত্তেজক বললাম । শরীরটাকে যথাযথ আগলে আড়াল করতে না পারার জন্য । সেটা যদি ফিল্মী কিংবা অধুনা মডেলিং-এর নানা বিতর্কিত ঢংগী কায়দায় পরিধান করা হয় ! তাহলে তো আরো সেরেছে ! সমাজের সব রক্ষাকর্তারা মাঠে ঘাটে কথার ঝালে আগুন ঝরাবে নিশ্চয় ।
অথচ সবচেয়ে জ্বলজ্বলে সত্যি হলো এই যে, আমার মা-খালা, নানী-দাদী সবাইকে আমি এই শাড়ীই পরতে দেখেছি । সেটা কি আদৌ আমার চোখে উত্তেজক অশালীন লেগেছিলো কোনো দিন ! লাগেনি নিশ্চয় । আমারও যেমন, তেমনি আপনারও । ঠিক কিনা !
যে দেশে থামি, যে দেশে কাঁচুলি, যে দেশে ঘাগড়া, যেখানে স্কার্ট-টপস, প্যান্ট-গেঞ্জী কিংবা যে যুগে বাকল, পাতা, উদাম শরীর সে রকম কোনো দেশে কী কোনো কালেই মা-খালা, নানী-দাদী, বোন-ভাবী কাউকে দেখে একটুও খারাপ কিছু মনে হয়নি কারো । এটা অনেকটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ।
তাহলে ! রীতি ভাংগাটাই সমস্যার শিকড় ! সূতিকাগার ! এই সবের সম্পূর্ণ অসুরটুকু আসলে আর কিছুতে নয়, কেবলি মানুষের মনে । দৃষ্টিভংগীতে । কু-চিন্তা এবং কু-দৃষ্টিতে ।
আজকাল কিছু ছেলে-পুলে যেভাবে পশ্চাতদেশের ভাঁজ দেখিয়ে সুপারম্যানের ফ্যাশন মশকরায় মেতে আছে ! তারা কি আদৌ জানে তাদের ওই ফ্যাশনের শিকড় সূত্র কোথায় প্রোথিত ! জানলে আর বুঝলে নির্ঘাত তারা যারপরনাই লজ্জা পেতো । তেমনি মিনি-শর্ট ফ্যাশনে বিশ্বাসী এদেশের মেয়েরা কেউ থেকে থাকলে ওরাও পেতো লজ্জা ।
নিজ ঐতিহ্য আর কৃষ্টিকে চেনাবার মতোন শিক্ষা এবং প্রতিপালন যদি পেতো আমাদের সন্তানেরা তাহলে তাদের পরিধানের ভিমরতি তেমন করে পেয়ে বসার কোনো সুযোগই হতো না । এর পাশাপাশি কে কেমন পোষাক পরলো তা নিয়ে কদাকার ভাবনা ও অভিরুচিও তাদের কোনো কালে হতো না । নিজেকে চেনাবার আর ভালোবাসবার মন্ত্রটাই আমাদের সন্তানকে শেখাতে ব্যর্থ আমরা ।
পোষাকের তো কোনো ধরা বাঁধা প্রেসকিপশন থাকতে পারে না । ফুটবল আর ক্রিকেটের যেমন এক পোষাকে চলবে না । সাইকেল-গাড়ী-প্লেন-জাহাজ চালানো, কল কারখানায় মেশিন চালানো, দোকানে বাজারে কেনা-কাটা করা, নামাজ পড়া, পুজো-আর্চা করা, স্কুলে-কলেজ যাওয়া, অফিস আদালতে কাজ করা ; এমন সব ক্ষেত্রে একই রকম পোষাকের প্রয়োজন আছে এমন কোনো দাবী উত্থাপনের কোনো যুক্তি নাই । বরং বাস্তবতার নিরিখে এমন ভিন্ন প্রেক্ষিত ভিন্ন পোষাকের প্রয়োজনটুকুই দাবী করে ।
আমরা খাই নিজের জিভের তৃপ্তির জন্য । কখনোই অন্যের তৃপ্তির জন্য নয় । আবার পরিধান করি অন্যের মুগ্ধতা অর্জনের জন্য । এটা সার্বজনীন সত্য । সেই অন্যটি কে । প্রথমে আমার প্রিয়জন । যাদের ভালো লাগা আমাদের আপ্লুত করে বেশী । তারপর আমাকে যারা যারা দেখবে, জানবে । অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশ, আমাদের সমাজ । চীন দেশে গিয়ে হিব্রু আর নিকারাগুয়ায় যদি আমি চীনা ভাষায় কথা বলতে চাই । বিপত্তি অনিবার্য । আর তাতে দোষটি ভাষার নয় । যে ভুল করলো তার । তেমনি ভাবে ভুল পরিধানে দোষটি পোষাকের নয় । যে ভুল পোষাক নির্বাচন করলো তার । এখন তার জন্য কি তার ওই কাপড়টুকুন খুলে নিতে হবে ! অমন করতে চাইলে কিংবা করবার কথা কেউ ভাবলে বৈকল্যটি সেই করনেওয়ালা আর ভাবনেওয়ালার । তবে সবচেয়ে বড় সত্য হলো এই দ্বিতীয় দলের এরাও সবাই এই সমাজেরই কেউ ।
তাই আমাদের ঘৃণা আর প্রতিরোধটাকে হতে হবে অপরাধের বিরুদ্ধে । অপরাধীর বিরুদ্ধে নয় । নৈতিক বৈকল্যের বিপরীতে সমাজের গতিকে সঞ্চালিত করতে হলে আমাদের সবাইকেই ভব্যতা সভ্যতাকে আপন কৃষ্টি সৌকর্যে সাজিয়ে, তাকে প্রদীপের আলোর কাছে পৌছে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা ও জ্ঞানের হাপড়ে গড়ে পিটে নিতে হবে ইস্পাতের মতোন ।
কারণ সবচেয়ে বড় সত্য এই, যে পোষাকের দোহাই দিয়ে অশালীন বলে অঙ্গুলি নির্দেশ করবে ! কিংবা সেই ইচ্ছার গলায় শিকল – হাতে হাতকড়া পরানোর উছিলায় আমার সন্তানকে অপমানিত করবার মতোন কদর্য মানসিকতার পরিচয় দিবে । এই অদ্ভুতুরে মানুষগুলো কারা ! এরা সবাই কিন্তু আমাদেরই ভাই কিংবা সন্তান । তাই দোষটা যতোটা তাদের, ততোটাই আমাদের । আমরা যারা ওদের বড় করে তুলছি, সেই আমাদের । প্রত্যেকের ।
মনীষীর কথা ধরে বলবো কি ! আরে ভাই পোষাকেই তো পরিচয় ! আর সেই সাথে জামার পকেটেই ভরবো বুঝি উপহারের পোলাও-বিরিয়ানী । যুগটা এখন আর সেখানে থেমে নেই । এখন বৈশ্বিক সংযোগ ও সম্পৃক্ততায় মেধা-চিন্তা-চেতনার প্রভেদ রাষ্ট্রের সীমানা ডিংগিয়ে বিলীন হবার পথ ধরে হাঁটছে । ভৌগলিক সীমারেখায় তা আর আঁটকে নেই।
যে চোরকাঁটা আমাকে অনবধানে হুল ফুটিয়ে দিয়ে যাবে তাকে বুঝি আমি জামা-কাপড়ের ভাঁজে নির্বিবাদ বহাল তবিয়তে থাকতে দিবো । এমন সব ভাবনা নিঃসন্দেহে চিন্তা-চেতনার বৈকল্যের ছবি ছাড়া অন্য কিছু আঁকে না ।
নিজ সন্তানকে দিয়েই তাই শুরু হতে হবে এর প্রতিকার । এছাড়া অন্য কোনো নির্মূল ঔষধি এর নাই । আমাদের প্রতিদিনের চর্চায় ও চলনে যতদিন না প্রতিটি ঘরে হবে এ দীক্ষার ক্লাস, প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, প্রতিটি শহরে . . . ততোদিন নিগৃহীত হবে আমারই সন্তান । আর যে করবে সেই লজ্জার কাজটি তাকে ওটা লজ্জা বলে না চেনাবার দায় । সেটাও আমাদেরই ।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এগুলোতো কোনো অলৌকিক রিমোট কন্ট্রোলে চলে না । চলে আমাদের ইচ্ছা, চর্চা, সচেতনতা, কী বিকারহীনতার সমন্বয়ে । আমাদের প্রতি দিনের গানে, নাচে, কথায়, আচরণে, ঘরে, বাইরে, রাষ্ট্রযন্ত্রে আমরাই ত চালকের ভূমিকায়।
যারা নিজ ভাষা ও ভূমির স্বাধীনতার জন্য গোটা পৃথিবীতে একটি অনন্য জাতির পরিচয়ে স্বীকৃত। সেই মুকুটে আমরা চাইলেই পরাতে পারি আরো একটি সোনার পালক । আমার মেয়েটি গ্রীবা উঁচু করে পরে থাকবে আপন কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের নকশা মাখা সাহসী নোলক ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...