গলুইয়ের উঁচু আড়ালটায় বেশ খানিকটা ছায়া। দড়ি পাতা খাটিয়ায় হাতবালিশে কাত হয়ে আধঘুমে শুয়ে জমির শেঠ। সকালের রোদটা এখনো তেজ পায়নি। বাতাসটা থেকে থেকে হালকা পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। সাথে আঁশটে নোনা গন্ধের আমেজটা মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনাগুলোয় তুফানের ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে।
সেই হাফ প্যান্ট পরা বয়স থেকে এই গন্ধ, এই বাতাসের সাথে দিন-রাত রোদ-বাদলা ঝড়-তুফান। য্যান এইটাই জীবনের সবচাইতে বড় প্রেম। দেখতে দেখতে একুশটা বছর গেছে। সারেঙের ঘরটার দিকে তাকায় সে চোখ খুলে। কি ঝকঝকা রোদ ঝিকমিক করা কাঁচে ঘেরা সেই ঘরখানা।
মনের মধ্যে তুমুল স্বপ্ন ছিলো, সারেঙ হবে। তীব্র ঝড়ের মধ্যে ওই ছ্য় হাতের চাকার হাতল দাবড়ে শক্ত হাতে জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালাবে ট্রলার, এঞ্জিন বোট, হয়তো আরো বড় কিছু, জাহাজ। দিনে দিনে বুঝতে পারে শুধু বয়স বাড়লেই সে সুযোগ হাতে আসবে না। স্বপ্নের ঘুড্ডির লেজগুলো তাই জীবন থেকে খসতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু এই নোনা জল, আঁশটে গন্ধ আর মাতাল ঢেউয়ের দোলায় জান বাজী রাখা সাগরের গান এতোদিনে শরীরের কোষে কোষে মিশে গেছে। মুটে থেকে খালাসীর সহকারী। তারপর খালাসী। শেষে সর্দার। সেই একঘেঁয়ে জীবনে নতুন তকমা জুটলো, যখন মাছধরা ট্রলারের পাশাপাশি সমুদ্রে নামলো ছোট ছোট ঝা চকচকা এঞ্জিন বোট। পর্যটক যাত্রীরা ঘোরে তাতে চেপে। কাছাকাছি দ্বীপে যায় আসে, গন্তব্যহীন ভাসে দিনে রাতে।
মনে মনে হেসে ওঠে মানুষটা। অনেকের চেয়ে ম্যালা ভালো আছে সে। কোনো আক্ষেপ নেই। খালাসী সর্দার হয়েই তো এক প্রকার সুখী ছিলো। এখন আবার পোষাকেও কেতা হয়েছে। কোম্পানীর পাটভাঙ্গা ড্রেস পরে ডিউটি করে। সাহেব সুবো মানুষ-ম্যামদের নিয়ে দিন কাটে। মাছের আঁশটে নোনাজলে ভিজে আর দিন যায় না তার।
কষ্টের দুই যুগে যা শিখেছে তাতে এমন একখানা বোট সে চালাতে পারে ভালোই। অবশ্য তাতে খুব হেরফের আর কি! লেখা পড়া যে জানা নেই মোটেই। ওটুকু না থাকলে তো যো নেই ওই কাপ্তানের চাকা হাতে নেয়।
এই বোটের কাপ্তান মানুষটা বেশ ভালো। তার জন্যই তৃপ্তি আর আনন্দের পাল্লাটা ভারী বেশী এই কাজে আসবার পর থেকে। দু’দিনের চুক্তি ট্রিপে মাঝে মাঝে ওর হাতে কাপ্তানের চাকার ভার দিয়ে লোকটা উঠে পড়ে হুইল হাউসের ছাদে। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে কিংবা কোনো বৃষ্টির রাতে। কিছুটা সময়ের জন্য তখন জমির শেঠ তার স্বপ্নের জীবনটায় ঘুরে ফিরে আসে যেনো।
হুইল হাউসের দখল পেলে তার চোখের ভেতর সাতশ তারার ঝিকিমিকি চকমকিয়ে ওঠে যেনো। জোড়া লাইটের জোরালো আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে ধ্যানমগ্নের মতো। দৃষ্টি তার বিঁধে থাকে কোনো অনন্তের দিকে। সামনের কন্ট্রোল প্যানেলের রেডিও ট্রান্সমিটার, মোর্স কোডের বাতি, কম্পাস এসবের দিকে চকিতে চোখ বুলিয়ে মাঝে মাঝেই সে ভাবে, ‘ওসব ছাড়াও আমার চলে’। এই সাগরের মাঝে চোখ বেঁধে এমন বোট চালাতে দিলেও সে পারবে তা অনায়াসে। বলতে গেলে নিজ করতলের মতোই তার চেনা হয়ে গেছে এ সাগর । এর সঙ্গেই তো জীবনের সব সুর বাঁধা। সুখ দুঃখের রাগ সাধা।
জমিলার অভিমানী মুখটা মনে পড়ে। সাগরটারে মাঝে মধ্যেই খুব হিংসা করে জমিলা। ক্যান করে! শিরায় শিরায় উত্তাল ঢেউয়ের সাথে যুঝে চলার যে নেশা তাকে এই জলের বুকে ভাসিয়ে নিয়েছে দুই কুড়ি বছরের বেশী। সেই প্রেম! সেই টানেরে তার হিংসা !
একমাত্র ছেলেটার নাম রেখেছে সে সূরুয শেঠ। স্কুলে পড়া তার শেষ হয় য্যান কাপ্তান হওয়ার পরে। জেগে থাকলেও এই স্বপ্নটা তাকে তাড়া করে। ব্যাপারটাকে সে এক রকম উপভোগও করে।
অথচ খুব ভালো জানে সে - এই সাগর যে কোনোদিন কাউকে টেনে নিতে পারে অনন্তের পথে। যে কোনো সকাল হতে পারে কারো নিকটজনদের শোকে পাথর হবার কাল। কতোজনকেই তো এই জীবনে দেখলো যেতে সে, না ফেরার দেশে। তবু স্বপ্নমগ্নতায় বুঁদ হয়ে প্রতিটি দিন সে ভালবাসে প্রতিটি সমুদ্র যাত্রা। মনের মধ্যে এ যেনো তার এক রকম যাত্রা নিরুদ্দেশ।
কখন চোখ জোড়া আবার বুঁজে এসেছিলো টের পায়নি। তার সারেঙ, কাপ্তার আবীর স্যারের গলায় চোখ মেলে উঠে বসে জমির শেঠ। “আজকে দিনের ট্রিপ বিকেলে শেষ করে সময় বেশী পাবেনা। সন্ধ্যায় দুই দিনের সফরে নোঙ্গর তুলতে হবে কিন্তু। আসার পথে শুনলাম বিকালে সাত নম্বর ঘোষণা দিতে পারে। খেয়াল করে গুছিয়ে নিও কিন্তু সব। বুঝলে তো জমির !”
একটা বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। এক কুড়ি মানুষ নিয়ে জলে দাপিয়ে চলার যানটাও যেনো আলাপে যোগ দিতে একখান হালকা দুলুনি দিয়ে ওঠে। একজোড়া শঙ্খচিল ডানা ঝাপটে হুইল হাউসের ছাতে লহমার বিরতি নিয়েই আবার উড়ে যায়। সেই যাওয়া ছোট্ট ডেকটায় জুড়ে থাকা বাতাসটাকে নাড়িয়ে দ্যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন