বামাচরণের ঘর আলো করে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখে বাবা-মা দু’জনেরই চোখ কপালে উঠলো। সন্তানের পা’দুটো এতটাই ক্ষীণ যে সে দুটোকে পাটকাঠি বলে ভ্রম হয়। মা অভাগী দেবী দুঃখে চোখের জল ফেললেন নিঃশব্দে। বাপ বামাচরণ পাথর হয়ে বসে ভাবনায় ডুবে থাকেন সবসময়। এই পুত্রের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে বড়ই চিন্তিত।
যাই হোক্ পুত্র বড় হতে লাগলো স্বাভাবিক নিয়মে। নামকরণের সময় বাপ বামাচরণ অনেক ভেবেচিন্তে পুত্রের নাম রাখলেন ক্ষীণচরণ। কচি ক্ষীণচরণের শরীরে ওই একটাই মাত্র খুঁত। নইলে তার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানোর জো’টি থাকে না। এতটাই সুন্দর দেখতে সে। ক্ষীণচরণের মা অভাগী দেবী ছেলেকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন আর শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন।
যাই হোক্ পুত্র বড় হতে লাগলো স্বাভাবিক নিয়মে। নামকরণের সময় বাপ বামাচরণ অনেক ভেবেচিন্তে পুত্রের নাম রাখলেন ক্ষীণচরণ। কচি ক্ষীণচরণের শরীরে ওই একটাই মাত্র খুঁত। নইলে তার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানোর জো’টি থাকে না। এতটাই সুন্দর দেখতে সে। ক্ষীণচরণের মা অভাগী দেবী ছেলেকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন আর শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন।
বামাচরণ দুঃখী স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেন, আহা, ওইটুকু খুঁত ছাড়া এমন সুন্দর পুত্র পেয়েছো তুমি। অমন সুন্দর পুত্র অনেক খুঁজে আর একটাও পাবে না এই শহরে। ওকে নিয়ে ভেবো না। আমার যা টাকাপয়সা রয়েছে তা দিয়েই পুত্রের ওই খুঁতটুকু ঠিক ঢেকে দেবো। দেখে নিও তুমি।
মায়ের মন তাতে বাঁধ মানবে কেন? তিনি একহাতে চোখের জল মোছেন। অন্য হাত দিয়ে কবিরাজি তেল মালিশ করেন পুত্রের ক্ষীণ চরণ দুটিকে শক্তপোক্ত করার আশায়। বুকে আশা পুত্রের এই ক্ষীণচরণদুটি একদিন শক্তপোক্ত হয়ে উঠবেই তাঁর হাতের গুনে।
যাইহোক্ ক্ষীণচরণ একদিন বড় হলো। দু’পায়ে হাঁটতে না পারলেও এদিক সেদিক চলে যায় পেছন ঘষটাতে ঘষটাতে। ভয়ডর বলে কোনো বস্তুই যেন তার মনে স্থান পায়নি। বাপ বামাচরণ দূর থেকে দেখেন আর ভাবেন, আর কিছু না হোক পুত্রের হাতদুটো কিন্তু শক্তপোক্ত হচ্ছে এতে। এই পুত্রই একদিন পৃথিবী শাসন করবে ওই হাতদুটো দিয়ে। এসব ভেবেই পুত্রকে উৎসাহ দেন। যেখানে সেখানে চলে যেতে দেখেও বাধা দেন না।
ক্ষীণচরণের বয়স যখন সাত বছর হয়েছে ঠিক তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। বাপের আশকারা পেয়ে পেয়ে ততদিনে ঘরের বাইরেটা বেশ চিনে নিয়েছে সে। কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না। মা অভাগীদেবীর চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যায় বাইরে। সেদিনও মায়ের চোখ এড়িয়ে পালাতে গেছিলো বড় রাস্তার ওদিকের খোলা মাঠটায়। বেশ কিছু কচিকাঁচা খেলা করছিলো সেখানে। মন্দ কপাল। পেছন ঘষটাতে ঘষটাতে রাস্তার মাঝখানে পৌঁছোতেই একটা মোটরগাড়ি এসে হামলে পড়লো তার ওপর। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো তার ক্ষীণ চরণদুটি। বলতে গেলে মোটরগাড়িটা তাকে ক্ষীণচরণ থেকে একেবারে হীনচরণ করে ছাড়লো।
বামাচরণ এতটুকুও দমলেন না তাতে। পুত্রের উপযুক্ত চিকিৎসা করালেন শহরের সেরা নার্সিংহোমে রেখে। সেরা ডাক্তারদের হাতে পুত্রকে সপে দিয়ে। হীনচরণ ওরফে ক্ষীণচরণ একদিন বাড়ি ফিরে এলো সুস্থ হয়ে।
বাড়িতে এসে বামাচরণ পুত্রকে সাহস যোগালেন, ভয় পেও না সোনা। সবসময় তোমার পাশেই আছি। ঐ বিশ্রী চরণদুটো গেছে তো কি হয়েছে। তোমাকে এমন দু’টো চরণ উপহার দেবো যা দিয়ে তুমি একদিন বিশ্বজয় করবে।
যেমন কথা তেমন কাজই করলেন বামাচরণ। অনেক টাকাপয়সা খরচ করে বিশেষ ধাতুর তৈরী একজোড়া চরণ আনালেন বিদেশ থেকে। সেই ধাতুর চরণ পেয়ে হীনচরণ পুত্র আবার ক্ষীণচরণ হয়ে গেল।
বামাচরণের বাল্যবন্ধু কৃষ্ণধন বহুকাল বাদ দেখা করতে এলো বন্ধুর সাথে। তিনি ক্ষীণচরণকে ধাতুর পায়ে তড়তড়িয়ে হাঁটতে দেখে অবাক হলেন। তাকে উৎসাহও দিলেন প্রচুর। ফিরে যাবার আগে বামাচরণকে একটি সুপরামর্শ দিয়ে গেলেন, ওহে বামাচরণ, এই পুত্রকে তুমি অলিম্পিয়ান তৈরি করো। প্যারা অলিম্পিয়ান। দেখে নিও কালে কালে খুব নাম করবে ও। তোমার এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে তাতে।
বাল্যবন্ধুর পরামর্শ বামাচরণের মনে ধরলো খুব। পরদিনই পুত্রকে তুলে দিলেন একজন দৌড়বীর ওস্তাদের হাতে। পুত্রকে দৌড়বীর বানিয়ে ছাড়বেন এই পণ করে। ওস্তাদের কাছে তালিম পেয়ে ক্ষীণচরণ কালে কালে একজন দৌড়বীর হিসেবে খুব নাম করলো। প্রথমে শহরে। তারপর জেলায় খুব নাম কামালো প্যারা দৌড়বীর হিসেবে। তারও পর দেশের হয়ে প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে প্রচুর মেডেল পেতে লাগলো। প্যারা অলিম্পিয়ান ক্ষীণচরণের নাম দেশ-বিদেশের মানুষজনের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো।
সেই থেকে ক্ষীণচরণের জীবনধারাটাই আমূল বদলে গেল। অনেক অনেক টাকা হলো। টাকার টানে বেশ কিছু সুন্দরী বান্ধবীও এসে জুটলো তার কপালে। সেইসব সুন্দরীদের কাছে ক্ষীণচরণের ধাতুর পা’দুটো তেমন গুরুত্বই পেলো না। ক্ষীণচরণ দু’হাতে তাকা ওড়াতে লাগলো সুন্দরীদের পেছনে।
বামাচরণ সব দেখেশুনে বিপদের সংকেত পেলেন। উপায়ান্তর না দেখে একদিন পুত্রকে ডেকে উপদেশ দিলেন, শোনো বাছা, এভাবে টাকা ওড়াতে ওড়াতে তোমার মাথাটাই না ঘুরে যায়। তাহলেই কিন্তু একেবারে গোল্লায় যাবে। পারলে নিজেকে সংযত করো।
ক্ষীনচরণ বাপকে ভারী পছন্দ করতো। তাই বাপের কথামতো চলাটাই মেনে নিলো। সুন্দরীদের আর পাত্তা দিলো না। টাকাপয়সা খরচ করে খুব হিসেব করে। সবকিছু আবার আগেরি মতো হয়ে গেল। দেখে বাপ বামাচরণ নিশ্চিন্ত হলেন। মা অভাগীদেবী খুব আনন্দিত হলেন পুত্রের এই পরিবর্তন দেখে।
বামাচরণ যতকাল বেঁচে ছিলেন ক্ষীণচরণের মধ্যে ততকাল তেমন কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা গেল না। কিন্তু বামাচরণ হগত হতেই ক্ষীণচরণের মধ্যে অদ্ভুৎ একটা পরিবর্তণ লক্ষ্য করা গেল। আজকাল ওস্তাদের কাছে তালিম নেবার চেয়ে নারীসঙ্গ পেতে বেশী আগ্রহী হয়ে উঠলো। এবং অহং ভাবটা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠতে লাগলো তার আচরণে।
সেই দেখে মা অভাগী দেবী ভাবলেন ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বিপথগামী হবার গেটটা বন্ধ করে দেবেন। সেইমত ক্ষীণচরণের জন্যে একটি সুন্দরী পাত্রী পছন্দ করলেন। সেই পাত্রীকে পুত্রের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, একটু দেখেশুনে নে বাবা। একেই তো বিয়ে করবি বাপের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে।
ক্ষীণচরণ আপত্তি করলো না। কিন্তু সুন্দরীদের সঙ্গও ছাড়লো না। একদিন এই নিয়ে তার এবং সেই সুন্দরী পাত্রীটির মধ্যে বেঁধে গেল তুমুল লড়াই। অহংকারী ক্ষীণচরণ রাগে অন্ধ হয়ে নিজের ধাতুর পাদুটো দিয়ে পাত্রীটিকে মেরেধরে সোজা যমালয়ে চালান করে দিলো। পুলিশ এসে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল তাকে। নামী প্যারা অলিম্পিয়ান বলে এতটুকুও রেয়াত করলো না।
তারপর থানা থেকে আদালত। আদালত থেকে সোজা জেলে চালান হয়ে গেল দেশের নামী প্যারা অলম্পিয়ান ক্ষীণচরণ। এখন জেলে বসে স্মৃতি হাতড়ে মরছে সে। সুন্দরীরাও কর্পুরের মতো উবে গেল তার জীবন থেকে।
বাপ বামাচরণ স্বর্গে বসে কপাল চাপড়াচ্ছেন তাঁর প্রিয় পুত্রের এই করুণ অবস্থা দেখে। বৃদ্ধা মা অভাগীদেবী নিভৃতে চোখের জল ফেলেন আর দোষ দেন নিজের পোড়া কপালের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন