শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

দোল উৎসবের ইতিকথা ~ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

শ'তিনেক বছর আগেকার একটি দিন। তখন বসন্তকাল। শীত ফুরিয়ে গেছে। বাতাসে চোরা গরম। কলকাতা তখন নিতান্তই খাল-বিল-নদী-নালায় ভরা জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটি গ্রাম। এমন দিনেই জোব চার্নক কলকাতায় এলেন সদলবলে মাথায় একরাশ কালোমেঘ এবং বর্ষার মুষলধারা নিয়ে। এসে উঠলেন সুতানুটির ঘাটে। নবাগত ইংরেজ নন্দনদের নিয়ে থাকতে লাগলেন কখনো তাঁবুতে, কখনো নৌকায় আবার কখনো বা বজরায় ঠাসাঠাসি হয়ে। বয়স্ক ইংরেজরা ব্যাপারটি মেনে নিলেও, তরুণদের পক্ষে এই পরিবেশের একঘেয়েমিকে মানা ছিলো কঠিন। মাঝে মাঝে এরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন।
সেবার বসন্তকালে এই নিয়েই একটা ঘটনা ঘটে গেল। কয়েকজন ছোকরা ইংরেজ সুতানুটি ছাড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন গ্রাম কলকাতায়। বসন্তের মনোরম পরিবেশে বাতাসে ভেসে এলো গানের সুর। সঙ্গে মাতিয়ে তোলা বাজনা। এরা কৌতূহলী হয়ে শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। পৌঁছুলেন এসে বিরাট এক দীঘির সামনে। এসে দেখলেন, দীঘিটির উত্তর ও দক্ষিণে দুটি খাড়াই মঞ্চ। জানলেন, দক্ষিণের মঞ্চে অধিষ্ঠিত যিনি তিনি হলেন গোবিন্দজী। দীঘির উত্তরে যিনি রয়েছেন, তিনি হলেন যুবতী রাধিকাজী। দুই দেবদেবীকে মাঝখানে রেখে চলেছে রঙের খেলা। যারা রঙ খেলছেন তাদের কেউ সেজেছেন পুরুষ, কেউ নারী। পুরুষদের রাখালবেশ, তারা গোবিন্দজীর পক্ষে। যারা সখীবেশে ছিলেন তারা গোপিনী এবং রাধিকাজীর পক্ষে। রাখাল আর গোপিনীরা মেতে উঠেছেন আবীর যুদ্ধে। তারসাথে চলছে তরল রং নিয়ে পিচ্‌কিরির খেলা।
দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে অনেক লোক এসেছেন এই খেলা দেখতে। দীঘির উত্তর পাড়ে জাঁকিয়ে বাজার বসেছে, রাধাবাজার। পাহাড়ের মত স্তূপ করে রাখা হয়েছে আবীর। পথঘাট লালে লাল হয়েছে আবীরে। দীঘির জলও রাঙা হয়ে লালদীঘি হয়েছে। সঙ্গে চটকদারি গান যুক্ত হয়ে উৎসবটাকে যেন আরও জমজমাট করেছে। উত্তেজক সঙ্গীত, গা-গরমকরা গান।
ছোকরা ইংরেজরা প্ররোচিত হলেন গোপিনীদের নৃত্যে ও লাস্যে। এরা যে নারীবেশী পুরুষ তা ছোকরা ইংরেজদের বোধগম্য হলো না। এরা এটিকে প্রাচীন গ্রীসের স্যাটারনালিয়ার মতো ‘কামোৎসব’ বলে মনে করলেন। এই মদনোৎসবে তারা অংশীদার হতে চেয়ে চেষ্টা করলেন ভেতরে ঢুকতে। উৎসবমত্ত নেটিবরা তাদের বাধা দিলেন। কেবল বাধা নয়, ইংরেজ ছোকরাদের ওপর বেশ কয়েকটি চড়-চাপড়ও পড়লো।
এতকিছু থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে দোল-উৎসবের সম্পর্ক প্রাচীন এবং আজন্ম। বর্ণাঢ্য দোল-উৎসব কলকাতাবাসীদের প্রিয় উৎসব যা কিনা জনপ্রিয় এবং মদনোৎসবের আদলে গড়া। দোল-উৎসবে হোলি উৎসবের ঐতিহ্য, কামোৎসবের মত্ততা ও আচার-আচরণ আর শাবারোৎসবের উদাম অনৈতিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
একালে ‘ঝুলন’ বলে পৃথক একটি উৎসবের ব্যাপার থাকলেও আগে সম্ভবত ছিলো না। ঝুলনে দোল খাওয়া থেকেই দোল-উৎসবের উৎসার। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে উৎকীর্ণ রামগড় গুহার এক লিপিতে ঝুলন উৎসবের কথা বলা আছে।
লিপিসূত্রে জানা যায়, এ ঝুলন কোনো দেবদেবীর নয়। একান্তভাবে মানুষের দোল খাওয়ার কথাই এখানে বলা হয়েছে। এ দোল খেতো মেয়ে-পুরুষ উভয়েই। এই মেয়ে-পুরুষদের দোল খাওয়া একসময় বদলে গেল শিশুর দোল খাওয়ায়। মা যশোদাকে দেখা গেল তাঁর গোপালকে ঝুলনে দোল দিতে। এরপর আবার পরিবর্তন হলো। দোললীলায় কুশীলব হয়ে এলেন যুবক কৃষ্ণ এবং তাঁর যৌবনলীলা সহচরী শ্রীরাধা। এঁরা দেখা দিলেন মদন ও রতির ভূমিকায়। দেখা গেল, একাদশ শতকের আগেই রাধা-কৃষ্ণের দোল-উৎসব ও ঝুলনলীলা ভারতবর্ষের অন্যতম ধর্মোৎসবে পরিণত হলো। এই উৎসবের সময় ছিলো চৈত্র মাস। কিন্তু চৈত্রী উৎসব হয়ে টিকে থাকতে পারলো না। হোলির টানে তাকে সরে আসতে হলো ফাল্গুনে। ঝুলনে রাধাকৃষ্ণকে দুলিয়ে দিয়ে তাঁদের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হতো ফাগ-কুমকুম। দেওয়া হতো আবীর রাঙা জল। এ ধারাও দ্রুত বদলে গেল। ওই ফাগ-কুমকুম সহচরীদের ওপর বর্ষিত হতে থাকলো। সহচরীরাও হাতে তুলে নিলেন রঙের পিচ্‌কিরি। ধর্মীয় অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এটিই হয়ে উঠলো বেগবতী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদিকার ডেস্ক থেকে

উৎসবের আলোড়ন কিছুটা স্তিমিত , তবুও মনের অলিন্দে হৈমন্তী স্বপ্ন । বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষ মুখে , উৎসব তিথি এখন অন্তিম লগ্ন যাপনে ব...